করোনার অভিজ্ঞতা

‘ও জীবন ছাড়িয়া যাস নে মোরে’

অলংকরণ : আরাফাত

জ্বরের ঘোরে চোখ বুজলেই আগে দেখতাম, পায়ের কাছে বসে একটি মেয়ে আনমনে নাক খুঁটছে। তাকে এর আগে কখনো দেখেছি কি না মনে হয় না। তবু এই দৃশ্য জুম করে নিলে, মেয়েটির মন খারাপের ভেতর আমিও ঢুকে যেতে থাকি। তবে এবার আর পায়ের কাছে বসে আনমনে নাক খোঁটেনি কেউ। দৃশ্য জুম করে নিয়েও কারও মন খারাপের ভেতর আর ঢুকে পড়া যায়নি। বরং নিজের মন খারাপ নিয়ে একা একা লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে।

২.
পরী আর পারো বাসায় নেই। গ্রামের বাড়ি ঘুরতে গেছে। বাসায় একা আমি। সন্ধ্যার পর অফিস থেকে ফিরে আরও একা লাগত। খেয়াল করে দেখেছি, বাসায় ফিরে পরদিন ফোনে কথা বলার আগপর্যন্ত একটা শব্দ বলার মতোও কেউ নেই আশপাশে। মনে হয়েছিল, আসলে মানুষের মতো নির্জন আর কিছু নেই। কোনো দিন অসুস্থ বোধ হতো। এরই মাঝে একদিন মনে হলো, এই শীতে শহরে আর কোথাও ঠান্ডা নেই। সব ঠান্ডা এসে ভর করে আছে শরীরে, কাঁপছি। কথা আসছে না। আলজিব ধরে আছে খুব। তুমুল ঠান্ডার ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে জ্বর বাড়তে থাকে। পুরো শরীর ব্যথায় অবশ। নাড়ানো যাচ্ছে না। এমন ভয়ংকর ব্যথা হওয়ার অভিজ্ঞতা আগে হয়নি কখনো। হাঁটা যাচ্ছে না। ঘুম নেই সারা রাত। সংশয়, অজানা ভয়ে ভেতরে অস্থির হয়ে আছে। জানেন, ভোরে জল তেষ্টা পেয়েছিল খুব। বিছানা থেকে উঠলেই পানি। কিন্তু বেশ চেষ্টা করেও সেই পানি নাগালে নেওয়ার শক্তি আসেনি। এসব পরীকে বলব, সে শক্তিও নেই।

একা, তিনবেলা খাবারের কষ্ট আর শরীরের কষ্ট নেওয়া যাচ্ছিল না একদম। কান্না আসে খুব, কিন্তু চোখে জল আসতে দিই না। জল এলে ভিতু মানুষের সব সাহস ভেসে যাবে। আর ভিতু মানুষের সাহস ভেসে গেলে যা থাকে, তা হলো বেঁচে থাকার ভান। এসব বলিনি পরীকেও। খুব অস্থির লাগলে কোনোমতে বারান্দায় দাঁড়াই। দেখি, ফুটে আছে সব নাম বাহারি ফুল। জল দিয়ে বলি, আমার জন্য দুঃখ করো ফুল, দুঃখ করো। ঝরে পড়ার আগপর্যন্ত এই ব্যথা-যন্ত্রণা ও সমূহ কষ্টের পাশে ফুটে থাকো সুন্দর।

৩.
দিনের আলোয় গা ছেড়েছে জ্বর। শরীর এত দুর্বল, মনে হচ্ছে ভেঙেচুরে আছে সব হাড়। ব্যথায় ওজন বেড়েছে মাথার। এর মাঝেই নাশতা সেরে দুপুর ও রাতের খাবার তৈরি করে রেখেছি। জ্বর জ্বর লাগছে, তবে বাড়ছে না। মাত্রা স্বাভাবিক। রাতের না হওয়া ঘুম বিকেলে এসেছে। ভয়াবহতা কমিয়ে অফিস, পরী আর দুই বন্ধুকে দিয়েছি গত রাতের জ্বরের খবর। আর কেউ জানে না। জানালায় তাকিয়ে দেখি, ঘরে ফেরা পাখির ডানায় ভর করে ভয় নিয়ে আবার সন্ধ্যা আসছে নেমে।

রাত বাড়ার সঙ্গে জ্বরও বাড়ছে। মাপছি, কিন্তু দেখতে ইচ্ছা করে না—ভয়ে। এই ভয় বাড়তেই থাকে। শরীরে কী যে হচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে কোথাও তলিয়ে যাচ্ছি—ডুবে যাচ্ছি ঘোর অন্ধকারে। ঘুম নেই আবারও। ভাত মেখে খাওয়ার মতো শক্তি নেই আঙুলের। নিজেই নিজেকে জোর করেছি। তাই প্রচণ্ড বমনে ভেসে গেছে ভাতের থালা। কাঁদিনি, তবু চোখের জল বুক পর্যন্ত এসে থেমেছে। একটু হাওয়া লাগছে গায়ে। ভালো বোধ হচ্ছে। কিন্তু মাঝরাতে মনে হলো, একটা রেলগাড়ি ঝমঝম করতে করতে মাথার ভেতর ঢুকেই ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেল। আর যাত্রা বিড়ম্বনায় পড়া যাত্রীরা বিরক্তি নিয়ে মগজের ওপর ধুপধাপ নামছে আর উঠছে। হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে আছি। কিন্তু বুক! বুকেও তো ব্যথা ভীষণ। তাই বালিশে চাপ দিয়ে আছি বুক। বুঝতে পারি, বুকের ভেতর ডানা ভাঙা একটা লাল ফড়িং ধড়ফড় করছে। আর পেটের ভেতর ওই দ্রুতগতির রেলগাড়ির হাওয়া। এসব নিয়ে ভেসে যাচ্ছি...যেতে যেতে যেতে ডুবে যাচ্ছি কোথাও। কোথায়—জীবনের বাইরে!

৪.
রাত তিনটার দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল কাকেদের চিৎকারে। জানালার পাশে এত রাতে তাদের চিৎকারে ভয় আরও বেড়ে গেল। মনে পড়ে, এক ঝুম জুলাইয়ের রাতে হঠাৎ পাখিদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। আর তাদের চিৎকারের সুরে সুরে অনন্ত অস্তের দিকে চলে যাচ্ছিল মা। তাহলে কি আমিও অস্তের দিকে যাচ্ছি! এই পাখির সুর কি আমাকে অনন্ত অস্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছে! তাহলে পরী, পারো, বাবা আরও যারা এই নাম—এই চোখের দিকে তাকিয়ে আছে প্রেমে-স্নেহে-ভালোবাসায়, তাদের কিছুই জানাতে পারব না! অস্থির লাগে। মনে মনে বলি, ‘ও জীবন রে, ও জীবন ছাড়িয়া যাস নে মোরে, তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে মাইনসে কইবে মরা জীবন রে। তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে আদর করবে কে আমারে রে...।’

৫.
যে সময়ে ডাকার কথা, সে সময়ে পাখির ডাক কিছুটা থেমেছে। পুবের আকাশ রাঙা হলো। জ্বর কমেছে। আহা জীবন! ছেড়ে যায়নি এখনো। ছেড়ে যাওয়ার আগে এবার অন্তত প্রস্তুতি নিতে হবে। নিজেকেই ডিঙা ভাসাতে হবে। বিছানা ছেড়ে উঠে দেয়াল ধরে ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়েছি। দেখি, পাখিদের ডাকে সকাল ফুটছে খুব। জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকি। আলোর সঙ্গে পাখিরা এসে ডাকে। পাখিদের চাল আর ভাত ছিটিয়ে দিই। আসে না। বাটিতে জল রাখি, নেয় না। আহারে পাখি! আমি তো তোমাদের সুরেই আস্থা রাখি। গ্রহণ করো এই আহার। ভালোবাসো আমাকে-মায়া করো-দিলদরিয়া হও। ডাকো, ডেকে ওঠো মায়ার সুরে।

৬.
সারা দিন শরীরে স্বাভাবিক তাপমাত্রা। বন্ধুরা দরজার কাছে খাবার-ওষুধ রেখে গেছে। আহা, বন্ধু আমার। সেই খাবার দরজা থেকে এনে খাওয়ার সামর্থ্যও আজ কতটা ক্ষীণ। সারা দিন মনে হয়েছে, গত রাতের মতো আবার হলে, এবার ডিঙা আর ফিরে আসবে না। এসব কথা বলিনি পরীকে। বাবাকেও না। সঙ্গী হারিয়ে বাবার বয়স, বয়সের চেয়েও অনেক বেড়েছে। তাকে বাড়তি টেনশনে রাখতে চাইনি। এমন অবস্থাতেও সন্ধ্যার পর রোজ ফোনে বাবার সঙ্গে কথা বলেছি। বাবা কেবল খবর দেয়—‘শুনেছিস নাকি, হুদা মুন্সির বউ মরে গেছে; বাবলুর বড় ছেলেটা, ওই যে ডাক্তার, কয়েক দিন আগে মরে গেছে। দুই দিন পরেই আবার খবর দেয়, বাবলুর বড় মেয়ে ছাদ থেকে পড়ে মরে গেছে। যেদিন-ই কথা বলেছি, শুধু মৃত্যুর খবর পেয়েছি। মাঝে একটা সুখবর অবশ্য দিয়েছে। সেটা হলো শফিকের কুচকুচে কালো গাইটার সাদা ধবধবে বাছুর হয়েছে। এ ছাড়া আমি কেবল মৃত্যু নিয়ে আছি। ফেসবুকে কত কত মৃত মানুষের প্রোফাইল বন্ধু তালিকায় রেখেছি, তা–ও ভাবি। ভাবি, কত মৃত মানুষ এখনো আমার বন্ধু। মৃত্যু হোক আমারও। শুধু মনে মনে চেয়েছি, এই পরিস্থিতিতে হাসপাতালে যেন যেতে না হয়। আমি নিতান্ত মানুষ। বর্তমানে বাঁচি। প্রিয় সহকর্মী মঞ্জরী হাসপাতালে। ছয় দিনে হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসায় বিপুল টাকা খরচ হয়েছে। আমার টাকাই নেই। কে দেবে এত টাকা। এই চিন্তায় পাগল হবে বাবা, পরী, আমার ভাই-ভাবি। পারো! পারো কীভাবে ডানায় মেখে নেবে প্রজাপতির রং। উফফ। না। তার চেয়ে নিজেই অস্তের দিকে ভাসিয়ে দেব নিজের জীবনডিঙা। এ পথ পাড়ি দেব সাবধানে।

৭.
সন্ধ্যার পর থেকে আবারও জ্বর ১০১ পেরিয়ে যাচ্ছে ওপরের দিকে। গলা, ঠোঁট, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। চোখের ভেতর ভীষণ ব্যথা। মনে হচ্ছে, চোখের ভেতর গজাল বিঁধে আছে। চোখ খুলতে কষ্ট হয়। আবার গত রাতের মতো ডুবে যাচ্ছি। না, এবার আর ছাড়ব না। গুছিয়ে নিতে হবে সব। এমন শরীর নিয়েই উঠি। ঘর গুছিয়ে নিই। দরজা-জানালা খুলে দিই। যেন সকালে কেউ অন্তত উঁকি দিয়ে দেখতে পারে, আছি কি না। ঝরে পড়া ফুল কুড়িয়ে এনে রেখেছি মাথার কাছে। ঘ্রাণ নেই। যতই হারানো ঘ্রাণের রেওয়াজ করি, ততই ছড় ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়। তবু ঘরজুড়ে ছড়িয়ে রেখেছি সুঘ্রাণ। ডিঙিতে কী নেব সঙ্গে? আন্তোনিও মাচাদোর ‘হ্যাজ মাই হার্ট গন টু স্লিপ?’, ব্রুস স্প্রিংসটিনের ‘দ্য লাস্ট কার্নিভাল’ নাকি মোজার্টের ‘ডেথ সিম্ফনি’। হালকা সাউন্ডে তিনটিই শুনে নিয়েছি। তারপর বাণী মেসোর পাগলা সানাইর সুর শুনতে শুনতে গোছানো ডিঙা নিয়ে ডুবে যাচ্ছি আমি। ঠান্ডা লাগছে একটু। কপালে জলপট্টির অনুভূতি। মায়ের মতো একটা হাওয়া সরে গেল দ্রুত। পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল। ভোরে, দেখি জীবন নিয়ে ফিরে এসেছে ডিঙা। এই আনন্দে শুনেছি বহুক্ষণ রামপ্রসাদী আর বিক্রম সিং খাঙ্গুরা।

৮.
ছেড়ে দেওয়া জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দে বাঁচার ইচ্ছা হয়। জ্বর আর আসেনি। তবে শরীর বেশ দুর্বল। মাঝে মাঝেই ওই কোথাও ডুবে যাচ্ছির মতো ডুবে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সাহস রেখেছি নিজের ওপর। সন্দেহ তো আগেই ছিল। তাই পরীক্ষা করিয়েছিলাম জ্বর শুরুর কয়েক দিন পরই। রিপোর্ট ছিল—কোভিড পজিটিভ। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শ, স্বজন-বন্ধু-সহকর্মীদের ভালোবাসায় ডুবে যাওয়া অবস্থা থেকে তল খুঁজে পাওয়া গেছে। তাঁদের জন্য এই বেঁচে থাকার আনন্দের অর্ধেক পাঠালাম। ২৫ দিন পর আবার টেস্টের রিপোর্ট কোভিড নেগেটিভ এসেছে। শরীর তবু বেশ দুর্বল, পেটের ভেতর ওই রেলগাড়ির হাওয়া ঘুরছে।
পোস্ট কোভিড যন্ত্রণা নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি, আরও অনেক ফুল ফুটে আছে। এই ফুল ঝরে যাওয়ার আগেই পরী আর পারো আসবে। আবার বসব পাশাপাশি, একসঙ্গে প্রাণ খুলে হেসে নেব বহুদিনের না হাসাহাসি...

  • লেখক: সুজন সুপান্থ, কবি ও সাংবাদিক