ঐতিহ্যের নগরে নগরে

ইতািলর পিসা শহরে
ইতািলর পিসা শহরে
বিয়ের পর ছুটিতে স্বামী জোবাইদুল হকের সঙ্গে ইউরোপের তিনটি দেশ ঘুরে এসেছেন অভিনেত্রী মাসুমা রহমান নাবিলা। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? নাবিলা নিজেই লিখেছেন সেসব


‘রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন আ ডে’।

রোম শহরটি যে এক দিনে গড়ে ওঠেনি, সেই ধ্রুব সত্যটি টের পেলাম তেরমিনি স্টেশন থেকে হোটেলে যাওয়ার পথেই। স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে ১৫ মিনিটের দূরত্ব। সেই ১৫ মিনিটের প্রথম রোম দর্শনেই চোখে পড়ল সড়কঘেঁষা সবুজ পার্ক, বিশাল সব স্থাপনা আর ভাস্কর্য। এসব দেখতে দেখতেই অতি প্রচলিত সে কথাটি মনে উঁকি দিয়েছিল।

৩ নভেম্বর ২০১৮। দুপুরে পৌঁছেছিলাম রোমের ফুমিচিনো বিমানবন্দরে। সেখান থেকে মেট্রোরেলে তেরমিনি স্টেশনে পৌঁছাতে বিকেল গড়িয়েছিল।

ইতালির এই শহরে আসার আগে জল্পনাকল্পনার শেষ ছিল না। ইউরোপ শব্দটি শুনলেই মনে হয় ধ্রুপদি সভ্যতা, প্রাচীন শিল্প-সংস্কৃতি আর ছবির মতো অপরূপ শহরের এক মহাদেশের কথা। তাই বিয়ের পর আমি আর রিম (জোবাইদুল হক) ছুটি কাটানোর জন্য ইউরোপই বেছে নিয়েছিলাম। এই ভ্রমণের প্রথম দেশ ছিল ইতালি।

 সময় কোথা সময় নষ্ট করবার

সেদিন হোটেল কক্ষে ঢুকেই মনে হচ্ছিল, অযথা সময় নষ্ট করছি! রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘সময় কোথা সময় নষ্ট করবার!’ তাই চটপট বেরিয়ে পড়লাম। পথ চলতে চলতেই পাকস্থলীর আর্তনাদ অনুভব করলাম। আর যাহোক, ‘তাকে’ তো কষ্ট দেওয়া যায় না! ঝটপট ঢুকে পড়লাম এক রেস্তোরাঁয়। কী বলব, বিখ্যাত ইতালীয় পিৎজা আর পাস্তার অসাধারণ স্বাদ এখনো জিবে লেগে আছে!

এভাবেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। চলে গেলাম ক্যাম্পো দা ফিওরি চত্বরে। ইউরোপের সবখানেই স্ট্রিট আর্টিস্ট বা পথশিল্পীদের দেখা মেলে। এই শিল্পীরা তাঁদের বাদ্যযন্ত্র, গান, নাচ বা কৌতুক পরিবেশনের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তাঁদের উপস্থাপনায় এমন নৈপুণ্য যে আপনাকে দাঁড়াতে বাধ্য করবেই! এখানেও এমন একজনের সাক্ষাৎ মিলল। তন্ময় হয়ে তাঁর পরিবেশনা দেখলাম।

রাতে শহর দেখতে দেখতে হোটেলে ফিরেছিলাম। পরদিন সকালেই বের হলাম দর্শনীয় স্থান ঘুরতে। প্রথমে চলে গেলাম পেনথিয়নে। হাজার বছরের পুরোনো এই মন্দির এখন একটি চার্চ, যেখানে অসাধারণ সব শিল্পকর্মের পাশাপাশি রয়েছে বিখ্যাত চিত্রকর রাফায়েলের সমাধি। ওখান থেকে লারগো দা টোরে আর্জেন্টিনা চত্বরে। বলা হয়ে থাকে, এখানে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করা হয়েছিল। বিশাল সব স্তম্ভ যেন সাক্ষী হয়ে আছে ঐতিহাসিক সেই ঘটনার। এরপর ছুটলাম ফন্টানা দা ত্রেভি দেখতে। এই ফোয়ারাতে পেছন ফিরে পয়সা ছুড়ে ফেললে নাকি আবারও এই জায়গায় আসার সৌভাগ্য হয়। এমন সুযোগ কে না চায়! আমরাও রীতি মেনে পয়সা ছুড়ে মারলাম।

প্যারিসের সিন নদীতে

 
ভ্যাটিকান সিটির ভেতর

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট স্বাধীন-সার্বভৌম দেশটি রোম শহরেই! শহর ঘুরতে এসে দেশ দেখা, কে হাতছাড়া করে সে সুযোগ! গেলাম ১১০ একর আয়তনের ভ্যাটিকান সিটিতে। ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস এখানেই থাকেন। ভ্যাটিকান সিটির অন্যতম আকর্ষণীয় স্থাপত্য হলো সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকা। এটি ১৬ শতকে পুনর্নির্মিত হয় যিশুখ্রিষ্টের ১২ শিষ্যের একজন সেন্ট পিটারের সমাধির ওপর। রয়েছে বিশাল এক জাদুঘর, যার প্রতিটি শিল্পকর্ম ৫ সেকেন্ড করে দেখলেও ১২ বছর লাগবে শেষ করতে।

পিসা পর্ব

রোম থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরের শহর পিসা। ট্রেনে দুই ঘণ্টার পথ। পিসার হেলানো টাওয়ারের ছবিটি অনেকের চেনা। ছোটবেলা থেকেই এটা আমাকে বিস্মিত করত। সবুজ ঘাসের পাশে শ্বেতপাথরের চার্চ আর এই হেলানো টাওয়ার এক অদ্ভুত সুন্দর। আমরা সন্ধ্যাটা কাটিয়ে দিলাম এই চোখজুড়ানো স্থাপনাটি দেখে। মনে হচ্ছিল, চোখ জুড়ালেও মন ভরছে না! ছোটবেলার ইচ্ছাটা পূরণ হওয়ায় খুব আনন্দ লাগছিল। আর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি পাশে ছিল বলে আনন্দের পারদ ছিল ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী!

এভাবেই ইতালির ফ্লোরেন্স আর ভেনিসে দুদিন কাটিয়ে উড়াল দিয়েছিলাম নতুন দেশ স্পেনে।

 উড়াল দিলাম স্পেনে

স্পেনের বার্সেলোনায় আসার ইচ্ছা পুষে রেখেছিল রিম। কারণটা তার ফুটবলপ্রীতি। সে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার পাঁড় ভক্ত। বার্সেলোনায় নেমেই জানলাম, বিখ্যাত এই ফুটবল ক্লাবটির একটি ম্যাচও আছে। আমরা চলে গেলাম ন্যু ক্যাম্পে। গ্যালারিতে বসে স্বচক্ষে মেসিকে খেলতে দেখা, এ তো স্বপ্নেরও অতীত। রিম আনন্দে উল্লসিত। আমার জন্য আরও স্মরণীয় হয়ে থাকল। কারণ, গ্যালারিতে বসে এই প্রথমবার ফুটবল ম্যাচ দেখলাম। স্টেডিয়ামের উৎসবমুখর পরিবেশ আর সমস্বরে ক্লাব ফুটবলের আনুষ্ঠানিক গানের সুরটা সারা জীবন কানে বাজবে।

সূর্যাস্তের সাক্ষী

বার্সেলোনা থেকে গন্তব্য ছিল রাজধানী মাদ্রিদে। প্রাণোচ্ছল এই শহরটা নানা কারণে আমাদের মনে থাকবে। মাদ্রিদের প্রাচীন মন্দির ‘টেম্পল ডেবোডে’ বসে প্রথমবারের মতো আমরা একসঙ্গে সূর্যাস্ত দেখেছি। সেখানকার রাজপ্রাসাদ ঘুরে দেখেছি, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ স্পেনের রাজার কাছে আসা হারিয়ে যাওয়া সৈনিকদের স্বজনদের অসংখ্য চিঠি আজও মানবিকতার স্মারক হয়ে আছে। আর ভেতরে প্রাসাদের বিভিন্ন রাজকীয় কক্ষ চোখধাঁধানো। কোনো রাজপ্রাসাদ ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতাও ছিল আমার প্রথম।

স্পেনের বার্সেলোনায় ফুটবল মাঠের গ্যালারিতে নাবিলা

 ভালোবাসার নগরীতে

মাদ্রিদ থেকে পা ফেলি ভালোবাসার নগরী প্যারিসে। আমরা এখন ফ্রান্সে। মেট্রো থেকে নেমে বাঁয়ে তাকাতেই দেখি, আকাশ চিরে কুয়াশাঘেরা বিশাল এক টাওয়ার দাঁড়িয়ে আছে। এটাই বিখ্যাত আইফেল টাওয়ার। এর ওপর থেকে চোখ সরানো দুষ্কর। তাই পরদিনও চলে গেলাম রাতের আইফেল টাওয়ার দেখতে। রাতের অসম্ভব সুন্দর আইফেল টাওয়ার আমাদের মুগ্ধ করল। সে রাতেই আমরা সিয়েন নদীতে ভেসেছি একটি রিভার ক্রুজে বসে। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ভালোবাসার নগরীতে সেই মুহূর্তটি অমলিন হয়ে থাকবে।

 বাড়ি ফেরার পালা

দেখতে দেখতে কীভাবে তিনটি সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, বুঝতেই পারিনি। এবার দেশে ফেরার পালা। আবার আমরা ফ্রান্স থেকে ইতালির রোমে ফিরে আসি। এখান থেকেই ঢাকার উদ্দেশে ফিরতি ফ্লাইট। মনটা খুব খারাপ হলো। আবার সেই কর্মব্যস্ত জীবনে ফেরা! মনটাকে বোঝালাম, এটাই তো নিয়ম।

ইউরোপের দিনগুলো প্রিয়জনের পাশে থেকে অনেক কিছু দেখেছি, জেনেছি। এই দেখার আর জানার যেন শেষ নেই। তাই মনে মনে ভাবছিলাম, আবার সুযোগ হলে দুজনে ছুটে যাব ইউরোপের এই নগরীতেই। এই প্রাচীন শহরই যে আমাদের অনেক প্রথমের সাক্ষী। তত দিন ইউরোপের দিনগুলো জ্বলজ্বল করুক স্মৃতির মণিকোঠায়।

মাসুমা রহমান নাবিলা: অভিনেত্রী