এসএসসির ছুটিতে

মিনার রহমান, ছবি: প্রথম আলো
মিনার রহমান, ছবি: প্রথম আলো
মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ, এখন ছুটি। ছুটির এই সময়টা কীভাবে কাটিয়েছিলেন সংগীতশিল্পী মিনার রহমান? লিখেছেন তিনি

আমার মনে পড়ে, স্কুলজীবনে আমার একটা এমপিফোর প্লেয়ার ছিল। তখন বাসা থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করার অনুমতি ছিল না। স্কুলজীবনে অনেক বছর এই এমপিফোর প্লেয়ার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে আমার সঙ্গে ছিল। একটু সময় পেলেই আমি এই প্লেয়ারে গান শোনা শুরু করতাম। সারা দিন আমার কানে হেডফোন দেখতে দেখতে আম্মুর হঠাৎ কী মনে হলো কে জানে! এসএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার তিন মাস আগে একদিন আম্মু আমার কাছ থেকে ওটা নিয়ে গেলেন, আমিও খুব শান্ত ভঙ্গিতে আম্মুকে দিয়ে দিলাম। পরীক্ষা যেদিন শেষ হলো, সেদিন বিকেলে আম্মুর কাছে ওটা চাইলাম। আম্মু তার ড্রয়ার থেকে বের করে আমার হাতে দিলেন। আমি যেন সাত রাজার গুপ্তধন ফিরে পেলাম। এসএসসির রেজাল্ট ভালোই হয়েছিল।

আমার মনে হয়, এসএসসি পরীক্ষার পর ছুটির সময়টা আমাদের পছন্দের কাজ কিংবা ভবিষ্যতে আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে যে প্রাথমিক চর্চার প্রয়োজন, সেটার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা উচিত। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই সময়টাতে নিজেকে সময় দেওয়া উচিত। নিজের ইচ্ছাকে সময় দেওয়া উচিত। এ সময়টা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি তখন স্কুলজীবনে বানানো আমার গানগুলোকে একটা ‘কম্পজিশনাল স্ট্রাকচার’–এর মধ্যে নিয়ে আসি। অনেক গান অসমাপ্ত ছিল। পরীক্ষার পর ছুটিতে সেসব অসমাপ্ত গান শেষ করি, গানগুলোকে আরও পরিণত করার চেষ্টা করি। গানের লিরিক নিয়েও আরও বেশি করে কাজ করা শুরু করি।

ছুটিতে সময় কাটাও নিজের সঙ্গে

এসএসসি পরীক্ষার পর কি–বোর্ড চর্চার ক্ষেত্রেও নিজেকে আরও বেশি দক্ষ করার চেষ্টা করেছি, যা আমার গানগুলোকে অবকাঠামোগত দিক থেকে আরও পরিপূর্ণ করতে সহায়তা করেছে। ছোটবেলা থেকে প্রচুর বই পড়তাম। সে জন্যই হয়তো গান লেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এসএসসির পর বই পড়া আরও বেড়ে গেল। প্রচুর সিনেমা দেখা শুরু করলাম। শশাঙ্ক রিডেম্পশন ওই সময়ে দেখা আমার শ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলোর একটি, যা এখনো মনে দাগ কেটে আছে। যত পড়তাম, তত বেশি নতুন গান বানানোর উৎসাহ পেতাম।

ওই সময়ে আমি আমার ১৩টি গান নিয়ে একটি ডেমো অ্যালবাম করি। শুধু পিয়ানো বাজিয়ে রেকর্ড করেছিলাম গানগুলো। তখন যদি ডেমো অ্যালবামটা আমি না করতাম, তাহলে হয়তো আজ আপনারা ‘সাদা রঙের স্বপ্ন’ গানটি গুনগুন করে গাইতেন না। ওই ১৩টি গানের মধ্য থেকে ১০টি গান নিয়ে পরে আমি ডানপিটে নামে একটা অ্যালবাম করেছি। খুব সাইকেল চালাতাম। চট্টগ্রাম শহরে সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়াতাম আর ভাবতাম, আমার গানগুলো নিয়ে কী করা যায়? হয়তো একটা স্বপ্ন খেলা করত মনে।

স্কুলজীবনে গান নিয়ে আমার তেমন কোনো কৃতিত্ব নেই। আমি যে গান লিখি, সুর করি বা গান গাই—এটা তেমন কেউ জানত না। স্কুলজীবনে আমি সব পুরস্কার পেয়েছি ছবি আঁকায়। উপস্থিত বক্তৃতায় একবার পুরস্কার পেয়েছিলাম। সে সময় চট্টগ্রাম শহরের এমন কোনো চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ছিল না, যেখানে আমি অংশ নিইনি এবং পুরস্কৃত হইনি। সব কটিতেই হয় প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হয়ে ঘরে ফিরেছি। আমার চিটাগংয়ের বাসায় এখনো সেসব পুরস্কার, ক্রেস্ট, সনদ সাজানো রয়েছে। যতটুকু জানি, আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের রুমের দেয়ালে ‘শিশুশ্রম’ নিয়ে আঁকা আমার একটি ছবি এখনো টাঙানো রয়েছে।

মিনার এঁকেছেন তাঁর ছুটির সেই সময়টা

এসএসসি পরীক্ষার পর আমি ছবি আঁকাতেও সময় দেওয়া শুরু করি। সে সময় আমার একটি বড় স্কেচবুক ছিল, যেখানে প্রচুর কার্টুন আঁকতাম। নিজের লেখা গানগুলোর ওপর ভিত্তি করে অলংকরণ করতাম। এই স্কেচবুকটা নিয়েই পরবর্তী সময়ে আমি ছুটে গিয়েছিলাম উন্মাদ–এ। এই স্কেচবুকে আমার কার্টুন আর অলংকরণ দেখে আমাদের উন্মাদ–এর সম্পাদক, আমাদের বস (আহসান হাবীব) উন্মাদ–এ আমাকে কার্টুনিস্ট হিসেবে কাজ শুরু করতে বলেন। উন্মাদ–এ ছাপা হওয়া আমার প্রথম কার্টুনটিও আমার সেই স্কেচবুক থেকেই নেওয়া।

আমার কাছে মনে হয়, সেই স্কেচবুকের একটি বড় ভূমিকা আছে আমার জীবনে। মোটা আর চওড়া স্কেচবুকের পাতায় আমি সারা দিন ছবি আঁকতাম, লিখতাম। আরেকটি মজার বিষয় বলি। ওই স্কেচবুকে আমি গান লিখে রাখতাম। গানের ওপর ভিত্তি করে ছবি আঁকতাম। একদিন স্কেচবুকে লেখা সব গান এবং গানের অলংকরণগুলো আমি রং করলাম। এরপর স্ক্যান করলাম। ১৩টি গান নিয়ে যে ডেমো অ্যালবামটা করেছিলাম, সেটার প্রচ্ছদের নকশা করলাম। ভেতরে দিলাম গানের কথা আর অলংকরণগুলো। এভাবেই তৈরি হলো আমার প্রথম অ্যালবাম। আমি আসলে পুরো বিষয়টিকে উপস্থাপন করার মতো একটি জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলাম এবং এ কাজটা আমি করেছিলাম এসএসসির পরেই।

সেই স্কেচবুকটা এখনো আমার কাছে আছে। মাঝেমধ্যে পাতা ওল্টাই। পুরোনো কাজ দেখে স্মৃতিচারণা করি।

সব মিলিয়ে আমি এটুকুই বলতে চাই, এসএসসির পর এই কয়েক মাস ছুটির সময়টাতে তোমরা নিজেদের আগ্রহকে সময় দাও। যেখানে তোমাদের আগ্রহ, সেটা নিয়ে কাজ করা শুরু করো, সেটা নিয়ে পড়াশোনা করো। যদি ভবিষ্যতে তোমার পছন্দের কাজটি করতে চাও, তবে সেটার প্রাথমিক পর্যায়ের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করো। তাহলে দেখবে, যেটা তুমি করতে চাও, সেটা করার জন্য তোমার আগ্রহ আরও অনেক বেড়ে গেছে এবং তুমি যদি সেটার জন্য পড়াশোনা শুরু করো, তবে তোমার ভেতরে জীবনের লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একধরনের শক্তি অনুভব করবে।