অদম্য মেধাবী

একেকটা মুখ, একেকটা অনুপ্রেরণা

মেধাবী এই তরুণদের অনুপ্রেরণা দিতে, তাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেতে হাজির হয়েছিলেন অভিনয়শিল্পী মেহজাবীন, জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, ফেরদৌস, নাগরিক টিভির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আব্দুন নূর তুষারসহ নানা ক্ষেত্রের গুনীজনেরা। ছবি: সাইফুল ইসলাম
মেধাবী এই তরুণদের অনুপ্রেরণা দিতে, তাদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেতে হাজির হয়েছিলেন অভিনয়শিল্পী মেহজাবীন, জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, ফেরদৌস, নাগরিক টিভির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আব্দুন নূর তুষারসহ নানা ক্ষেত্রের গুনীজনেরা। ছবি: সাইফুল ইসলাম

অনুষ্ঠানের কী সবচেয়ে ভালো লাগল? প্রশ্ন করি কমলচন্দ্র রায়কে।
সে বলল, ‘খাবার। সবশেষে খাবারদাবারের আয়োজন খুব ভালো ছিল। সবাই আমাদের খুব যত্ন কইরা খাওয়াইছে। এত ভালো খাবার তো আগে কোনো দিন খাই নাই। আমার জীবনে এইটাই প্রথম, মনে হয়ে এইটাই শেষ।’
পঞ্চগড়ের ছেলে কমলচন্দ্র রায় আগে কখনো ঢাকায় আসেনি। ২৩ অক্টোবর, ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সুবাদে ৪০০ বছরের পুরোনো শহরটাতে এই প্রথম তার পা পড়ল। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ মিলনায়তনে অদম্য মেধাবীদের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল বড় পরিসরে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা অদম্য শিক্ষার্থীদের স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ, অভিনয়শিল্পী, গানের শিল্পীসহ গুণীজনেরা। নাচ হয়েছে, গান হয়েছে। মঞ্চের ‘লাল লাল নীল নীল বাত্তি দেইখা’ সত্যিকার অর্থেই ‘নয়ন জুড়াইছে’ কমলচন্দ্রের। কিন্তু এতসবের মধ্যেও তার সবচেয়ে ভালো লেগেছে খাবার। পোলাও, রেজালা, মিষ্টি, আইসক্রিম...খুব যে বিশেষ কিছু তা-ও নয়।
যে ছেলেটা দিনের পর দিন না খেয়ে স্কুলে গেছে, তার জন্য এটা অনেক বড় পাওয়া বটে। বজ্রপাতে বাবা মারা গেছেন ১৪ বছর আগে। মা অনেক কষ্টে, দিনমজুরের কাজ করে তিন ছেলেকে মানুষ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই একটা বিশেষত্ব নিয়ে বড় হয়েছে ছোট ছেলে কমলচন্দ্র। তার দুহাতের আঙুল নেই। কলম ধরতে খুব কষ্ট হয়। তাই বলে সে হাল ছাড়েনি। লেখাপড়া করেছে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় পেয়েছে জিপিএ–৫। গত ৯ জুন তাকে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোতে।

দেশের নানা প্রান্ত থেকে মেধাবীরা এসেছিল এই অনুষ্ঠানে

কমলচন্দ্রের মতো এ রকম অদম্য মেধাবীদের খুঁজে বের করেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা। প্রথম আলো ট্রাস্টের মাধ্যমে তাদের শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে শুরু হওয়া এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে এখন পর্যন্ত ৮৪০ জন শিক্ষার্থী সহায়তা পেয়েছে। ২০১০ সাল থেকে যুক্ত হয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। ব্র্যাক ব্যাংকের পাশাপাশি অন্যান্য দাতা সংস্থা ও ব্যক্তিপর্যায়েও অনেকে অদম্য মেধাবী তহবিলে সহায়তা দিচ্ছেন।
প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিলের সহায়তায় যেসব শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করেছেন, আর যারা এ বছর এই বৃত্তির আওতাভুক্ত হলো, সব মিলিয়ে মোট ১২৭ জনকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্যই কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ মিলনায়তনে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল। নটর ডেম কলেজের ছাত্র মো. আয়াতুল্লাহ বলছিল, ‘আমরা তো গ্রামের মানুষ। আমাদের সঙ্গে দেখা করতে নায়ক, নায়িকা, লেখক, এত বড় বড় মানুষেরা আসছে! খুব ভালো লাগছে।’ আয়াতুল্লাহ যাঁদের ‘বড় বড় মানুষ’ বলছে, তারা কিন্তু মঞ্চে দাঁড়িয়ে বারবার বললেন, অনুপ্রেরণা দিতে নয়, তাঁরা বরং নিতেই এসেছেন।
চিত্রনায়ক ফেরদৌস মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ‘আমি এসেছি সুবর্ণার সঙ্গে দেখা করতে।’ সেদিনের পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছিল অধম্য মেধাবী সুবর্ণা রানী দাসের কথা। জন্মান্ধ মেয়েটি এ বছর রাজবাড়ীর ইয়াসিন উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ ৫ পেয়েছে। ফেরদৌসের মুখে নিজের নাম শুনে কেমন লাগছিল? সুবর্ণা বলল, ‘কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি এমন কিছু হতে পারে। পরে আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। ছবি তুলেছি।’
সেদিন অনুষ্ঠানে যেই অদম্য মেধাবীরা হাজির হয়েছিল, প্রত্যেকেই তো একেকটা অনুপ্রেরণার গল্প। একটু আগেই যে আয়াতুল্লাহর কথা বলছিলাম, পটুয়াখালীর কলাপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পেয়ে নটর ডেম কলেজে ভর্তি হয়েছে। স্কুলজীবনে পড়ালেখার জন্য সে কখনো মাছ ধরেছে, ইটভাটায় কাজ করেছে। এখনো কলেজে পড়ার পাশাপাশি সে বাবাকে কাজে সহায়তা করে।
বাবা কী করেন? ‘একটা রিকশার গ্যারেজের বাবুর্চি। রিকশাওয়ালাদের জন্য রান্না করেন।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আয়াতুল্লাহ, আমি কি এই কথাটা পত্রিকায় লিখতে পারি?’ সে বলে, ‘লেখেন। সত্যি কথা বলতে তো কোনো সমস্যা নাই।’