‘প্রথমে জেনেছিলাম যমজ। প্রচুর ব্লিডিং হলে আবার আলট্রাসনোগ্রাম করে জানলাম, পেটে দুজন নয়, আছে তিনজন। ভয় পেয়েছিলাম, খুশিও হয়েছিলাম। এই তিনজন হলো দুই ছেলে আয়াত, আইযাত এবং এক মেয়ে আনাইযা। এখন মনে হয়, কাকে রেখে কাকে কোলে নেব, তিনজনকে একসঙ্গে নিয়ে ছবি তোলাও কঠিন। তিনজনই ভালো আছে,’ বললেন ইয়ান্না দেওয়ান। গত ৫ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে এই তিন সন্তানের জন্ম দিয়েছেন তিনি।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ করা ইয়ান্না জানান, বিয়ের তিন বছর পর স্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণ করেন তিনি। গর্ভধারণের পর জানতে পারেন তাঁর জরায়ুতে একটি টিউমার আছে। তারপর যমজ থেকে যখন ট্রিপলেটের কথা জানতে পারেন, তখন বেশ ভয় পেয়েছিলেন। তবে উচ্চ রক্তচাপ থাকা ছাড়া তেমন আর কোনো জটিলতা হয়নি। ইয়ান্না তাঁর চিকিৎসক রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বেনজীর হকের প্রতি কৃতজ্ঞ। বললেন, এই চিকিৎসকও নারায়ণগঞ্জের মেয়ে। সে সুবাদে নারায়ণগঞ্জেও চিকিৎসা দেন। বেনজীর হক ছিলেন তাঁর তিন নম্বর চিকিৎসক। ইয়ান্না বলেন, ‘এই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে ভালো লেগে যায়। তিনি যেভাবে কাউন্সেলিং করে সাহস দেন, তাতে ভয়টা কেটে যায়। অস্ত্রোপচারে সন্তানদের জন্মের চার দিনের মাথায় বাসায় চলে এসেছি। নবজাতকদের বিশেষ পরিচর্যাকেন্দ্রেও নিতে হয়নি।’
বেনজীর হক মুঠোফোনে হাসতে হাসতে বলেন, ‘আগেও আমার হাতে স্বাভাবিক প্রসবে একসঙ্গে তিনজনের জন্ম হয়েছে। সেবার জানতাম মায়ের পেটে যমজ বাচ্চা আছে, দুজনকে বের করার পর দেখি আরেকজনের হাত বের হয়ে আছে। গত অক্টোবর মাসেও নারায়ণগঞ্জেই আরেক মা তিনটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে আরেক মা তিন সন্তানের জন্ম দেবেন।’
১৯ নভেম্বর প্রথম আলোতে ‘একসঙ্গে একাধিক সন্তান কেন হয়’ শিরোনামের এক লেখায় ফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ ও ইনফার্টিলিটি কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের চিফ কনসালট্যান্ট রাশিদা বেগম বলেছেন, ্বাভাবিকভাবে একটি শুক্রাণু ও একটি ডিম্বাণুর নিষেকের ফলে একটি ভ্রূণ তৈরি হয় এবং সেটিই জরায়ুতে প্রতিস্থাপিত হয়ে মানবসন্তান হিসেবে ভূমিষ্ঠ হয়। কখনো কখনো দুটি বা তিনটি ডিম্বাণু একই মাসিক চক্রের সময়ে নিষিক্ত হলে দু-তিনটি বাচ্চা একই সঙ্গে হতে পারে।
চিকিৎসক বেনজীর হক বলেন, একের অধিক সন্তান জন্মে ভয়ের কিছু নেই। এই মায়েদের একটু বেশি যত্নের প্রয়োজন হয়। কাউন্সেলিং বেশি করতে হয়। মায়ের উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হাতে-পায়ে পানি আসা, পুষ্টির অভাবে পেটে কোনো একটি ভ্রূণ সেইভাবে বড় না হওয়া, সময়ের আগে জন্ম হওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। তবে যথাযথভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে ভয়ের কিছু নেই।’
শুধু চিকিৎসক বেনজীর হকই নন, আয়াত, আইযাত ও আনাইযার স্বজনেরাও এই তিনজনের বিভিন্ন ছবি পোস্ট করে সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। তেমনই একজন হলেন রাজধানীর উত্তরার মেডিকেল কলেজ ফর উইমেন অ্যান্ড হসপিটালের সহকারী অধ্যাপক (বায়োকেমিস্ট্রি) মিলিভা মোজাফফর। তিনি হলেন এই তিনজনের বাবা মামুন অর রশিদের ছোট মামি। মিলিভা নিজেও যমজ সন্তানের মা। তাঁর ছেলেরা এখন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
মিলিভা বলেন, ‘দুটো সন্তানকে একসঙ্গে বড় করতে গিয়েই কাহিল অবস্থা হয়েছিল। তাই বুঝি একসঙ্গে তিনজনকে বড় করা বেশ কঠিন কাজ।’ মিলিভা জানান, তাঁর ছেলেদের যখন মাত্র আড়াই বছর বয়স, তখন তাঁর কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে। একদিকে ছোট ছোট যমজ বাচ্চা, আরেক দিকে ক্যানসারের কেমোথেরাপিসহ অন্যান্য জটিলতা। তখন স্বামী, মা ও পরিবারের অন্য সদস্যরা তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
আয়াত, আইযাত ও আনাইযার বাবা মামুন অর রশিদ হাসতে হাসতে বলেন, একজনের কান্না থামলে ধারাবাহিকভাবে অন্য দুজনের কান্না শুরু হয়। তাই একমুহূর্তের জন্য বাচ্চাদের মাকে একা রাখা সম্ভব হয় না। পরিবারের কেউ না কেউ পাশে থাকেন।
রাজধানীর মহাখালীতে একটি আইটি ফার্মে কাজ করেন মামুন। প্রতিষ্ঠান থেকে পিতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছেন তিন দিন। এর সঙ্গে অন্যান্য পাওনা ছুটি মিলিয়ে ৯ দিনের ছুটি নিয়েছেন। আর করোনার জন্য হোম অফিস থাকায় বাচ্চাদের একটু বাড়তি সময় দিতে পারছেন। তবে এক সন্তানের বাবা হলে সন্তানের জন্য যে আয়োজন খুব ভালোভাবে করতে পারতেন, স্বাভাবিকভাবেই তিন সন্তানের জন্য ওই একই আয়োজন করতে একটু বেগ তো পেতেই হচ্ছে।