মা–বাবার বিয়ের ১২ বছর পর জন্ম হয় উদ্দীপনা খন্দকারের। তাঁর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে পুরো গ্রামেই আয়-উন্নতি বাড়তে থাকে। তাই ফুফা নাম রেখেছিলেন উদ্দীপনা। তবে উদ্দীপনাকে খেয়ে না–খেয়ে দিন পার করতে হয়েছে। সহ্য করতে হয়েছে নানান নির্যাতন। তবে থেমে যাননি। তাই উদ্দীপনার জীবনই এখন অন্যদের কাছে উদাহরণ হতে পারে বা উৎসাহ জোগাতে পারে।
সিরাজগঞ্জের যমুনাপারের মেয়ে উদ্দীপনা। বর্তমানে তিনি ডাচ্–বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের অ্যাসিস্ট্যান্ট রিলেশনশিপ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রাজধানীর দক্ষিণখান শাখায়। গত এক বছর ধরে তিনি এ দায়িত্বে আছেন। জীবনের তাগিদে তিনি বাবার সঙ্গে মাঠে ধানকাটা, খেতে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য ভাত নেওয়াসহ প্রায় সব কাজই করেছেন।
২০০৮ সাল। উদ্দীপনা নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। যমুনার ভাঙনে বাড়িছাড়া হলো উদ্দীপনার পরিবার। এক বান্ধবীকে পড়ানোর শর্তে বান্ধবীর বাড়িতে লজিং থাকতেন উদ্দীপনা। এসএসসি পরীক্ষা দিলেন এক ফুফুর বাড়িতে থেকে। পরীক্ষায় উদ্দীপনা এ-গ্রেড পান। ঢাকায় এক মাস এক চাচার বাসায় থেকে ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক্যালে ভর্তি হন উদ্দীপনা।
উদ্দীপনা বললেন, ‘একটি জমি বন্ধক রেখে ২ হাজার টাকা নিয়ে বাবার সঙ্গে ঢাকায় রওনা দিয়েছিলাম। ভর্তির সময় ১ হাজার ১০০ টাকা লাগবে। সেই টাকা তো নাই সঙ্গে। এক দুলাভাই নিজের পকেট থেকে এই টাকা দিয়ে আমাকে ভর্তি করান।’
ভর্তির পর এক ফুফাতো ভাইয়ের বাসায় আশ্রয় নিলেন উদ্দীপনা। অন্যদিকে গ্রামে শুরু হয়েছে নানান আলোচনা। মেয়েকে এত পড়ানো ঠিক হচ্ছে না। উদ্দীপনা বললেন, ‘তখন আমার মা বলেছিলেন মেয়েকে পড়ানোর জন্য মাটি কাটতে হলে তা–ও কাটব। আমার মেয়ে পড়বে।’
ফুফাতো ভাইয়ের বাসার আশ্রয় ছেড়ে এক আত্মীয়ের বাড়িতে এবার আশ্রয় পান উদ্দীপনা। সকালে একটি রুটি খেয়ে উদ্দীপনা ক্লাসে যেতেন, ফিরতেন বিকেলে। তারপর বাসার থালাবাসন ধোয়া, অন্য জায়গা থেকে পানি আনাসহ সব কাজ করে দিয়েও খারাপ ব্যবহার পেতেন। তারপর অনেক কষ্টে হোস্টেলে সিট পেলেন। তবে এক মাসের মাথায় বাড়ি থেকে খবর এল উদ্দীপনার মা মারা গেছেন।
মা মারা যাওয়ার চার মাসের মাথায় উদ্দীপনার বাবা আবার বিয়ে করেন। বাবা ও সৎমা ঢাকায় এসে উদ্দীপনাকেও সেখানে নিয়ে যান। একপর্যায়ে সৎমা বাসা থেকেই বের করে দেন। তারপর আশ্রয় মেলে এক বোনের বাসায়। স্ট্রোক করে এক হাত আর এক পা অবশ হলে বাবা আর সৎমা গ্রামে ফিরে যান। উদ্দীপনা সাবলেটে একটি হোস্টেলে থাকা শুরু করেন। বাড়ি থেকে টাকা পাঠানো বন্ধ হয়ে গেলে উদ্দীপনার পড়াও বন্ধ হয়ে যায়। পড়াশোনা শেষ করতে আর মাত্র দুটি বছর বাকি ছিল। বাবাও মারা গেলেন। সৎমা জায়গাজমি বিক্রি করে তাঁর বাবার বাড়ি চলে গেছেন। এই পৃথিবীতে উদ্দীপনার আপন বলতে আর কেউ নেই।
২০১৬ সালে উদ্দীপনা মিরপুর ২ নম্বরে আন্ডারপ্রিভিলেজড চিলড্রেনস অ্যাডুকেশনাল প্রোগ্রাম (ইউসেপ) নামক প্রতিষ্ঠানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইলেকট্রিক্যাল মেইনটেনেন্সে ভর্তি হলেন। ২৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে একমাত্র মেয়ে ছিলেন তিনি। ইউসেপের সহায়তায় উদ্দীপনা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সাবস্টেশন টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি পলিটেকনিক্যালের ডিপ্লোমা আবার শুরু করে গত বছর তা শেষ করেন। ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের চাকরিটি হওয়ার পর উদ্দীপনা কিছুটা শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পান।
উদ্দীপনা বললেন, ‘আমার শিক্ষকতা করার খুব ইচ্ছা। ইলেকট্রিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর হতে চাই। সোল্ডারিং, সুইচবোর্ডের তার সংযোগসহ সব কাজ পারি। কিন্তু শুধু ডিপ্লোমার সনদ দিয়ে ভালো চাকরি পাওয়া যায় না। বিএসসি ডিগ্রি প্রয়োজন। কিন্তু ৯টা–৫টা চাকরি করে তা সম্ভব না।’
উদ্দীপনা বললেন, ‘একটি মেসে থাকি। মা-বাবা নেই বলে কেউ বিয়ে করতে চান না। তবে আমি ভালো আছি। বিনা মূল্যে পড়ার সুযোগ এবং চাকরি পেতে সহায়তা করে ইউসেপ আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।’
প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে কথা শেষ করে উদ্দীপনা তাঁর ব্যাগ থেকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ভিজিটিং কার্ডটি এগিয়ে দিলেন হাসিমুখে।