সংসার সামলে ঘরে বসেই এখন নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন অনেক নারী। কেউ পোশাকে নকশা করছেন, কেউ বানাচ্ছেন ঘর সাজানোর উপকরণ, কেউ আবার রান্না করে অনলাইনে বিক্রি করছেন খাবার। ঈদের সময় তাঁদের ব্যস্ততা বাড়ে, বাড়ে উপার্জনও। সে উপার্জনেই অনেকে নিজের স্বপ্ন পূরণ করেন। এমন কয়েকজন নারীর গল্প শুনেছেন জোহরা শিউলী
মারুফা মিতু
সন্তানের দেখভাল করতে শিক্ষকতা ছেড়েছিলাম। এরপর বেশ কয়েক বছর বেকার থাকলাম। নিজের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছিল সে সময়। কিছু একটা করতে হবে। অন্তত নিজের হাতখরচের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হবে।
ভাবলাম, আমি ছবি আঁকতে পারি, পোশাকে ছবি আঁকি না কেন। শিশুদের পোশাক দিয়ে শুরু করলাম। ফেসবুকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল। এরপর শাড়িতে আঁকা শুরু করি। শিশুদের পোশাকে চিত্রকর্মের সঙ্গে ঈদের এই সময়টায় বেশি পরিমাণে পাঞ্জাবির ফরমাশ পাই। পাঞ্জাবির সঙ্গে সঙ্গে বিছানার চাদর, পর্দা বিক্রি বেশি হয়েছে গত কয়েক ঈদে। ঈদের ব্যস্ততাটা আমি উপভোগ করি। এ পরিশ্রমের পর যে উপার্জন হাতে আসে, তা দিয়ে পরিবারের সবার জন্য ঈদের কাপড় কিনি। নানা উপহার দিই। নিজের উপার্জনে সবাইকে উপহার দিতে পারা অন্য রকম আনন্দ।
জান্নাতুল ফেরদৌস
সারা বছর বিক্রি একটা সাধারণ গতিতে চলে। কিন্তু রমজানের শুরুর দিক থেকে তা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। আমি কুশির ব্লাউজ, ঘর সাজানোর নানা জিনিস তৈরি করি। ঈদের আগে প্রচুর ফরমায়েশি কাজ করতে হয়। টেবিল ম্যাট, রানার এসব ঘরোয়া জিনিস ঈদের সময় বেশি তৈরি করি। কিছু নিজের পছন্দমাফিক বিক্রি করি আর কিছু ফরমায়েশি কাজ থাকে। সেই সঙ্গে কুশির ব্লাউজ এবং শিশুদের নানা রকম পোশাকের ফরমাশ আছে ঈদে। আমি দিনাজপুরে থেকে কাজ করছি। ছোট ছোট দুই সন্তানকে চোখের সামনে রেখে কাজ করতে পারছি এটা মনে শান্তি দেয়। ঈদের সময় কাজের পরিমাণ বেশি থাকে। মাঝেমধ্যে খুব কষ্ট হয়ে যায়। তারপরও গুছিয়ে উঠি।
ঈদের এ উপার্জনটুকু নিয়ে অন্য রকম পরিকল্পনা থাকে। যেমন গত বছর ঈদের কাজ শেষ করে আমার খুব ইচ্ছা ছিল পুরো পরিবারকে নিয়ে কক্সবাজার বেড়াতে যাব। সে ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। নিজের খরচে ঘুরে আসতে পেরেছি। যেহেতু বেড়াতে পছন্দ করি, তাই ঈদের বেচাকেনার উপার্জিত অর্থ দিয়ে পরিবারকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকে।
ফারহানা রিতা
আমি কাপড়ে হাতের কাজ করি। সেই সঙ্গে কাঠ দিয়ে গ্রামীণ নানা ঐতিহ্য যেমন ঢেঁকি, গরুর গাড়ি, পুতুল—ছোট ছোট এমন পণ্য তৈরি করি। সংসার সামলে প্রথম দিকে ছোট আকারে শুরু করলেও পরে দেখি এ কাঠের পণ্যগুলোর চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে ঈদের সময় উপহার হিসেবে এগুলো অনেকে খুব কেনেন। ঈদ এলে আমার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। তখন দ্বিগুণ শ্রম দিতে হয়। রাত জেগেও আমি আমার পণ্য তৈরির কাজ করি।
সংসার দেখভাল করে ঘরে বসেই এসব সামাল দিই। নিজের উপার্জন বিষয়টা অন্য রকম। যখন উপার্জন করতাম না, তখন হাতখরচের টাকার জন্য চিন্তা করতে হতো। নিজের উপার্জনে সেই চিন্তা দূর হয়েছে। এখন নিজের প্রয়োজন, সংসারের প্রয়োজন মেটাতে পারি। ঈদে বছরের একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উপার্জন হয়। আমার ব্যবসার কাপড় রাখার আলমারি নেই। এবার ঈদের উপার্জন দিয়ে পরিকল্পনা করেছি একটা আলমারি কিনব।
নিশাত আফরীন
একসময় শখের বশে রান্না করতাম। সবাই আমার রান্নার প্রশংসা করত। নিকটজনের প্রশংসায় অনুপ্রাণিত হয়ে দু-একটা রান্নার প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। পরে সংসারের, নিজের প্রয়োজনে মনে হয় স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে আমার নিজের উপার্জনেরও একটা পথ থাকতে হবে। যেহেতু রান্নাটা ভালো পারি, তাই খাবারের ব্যবসা শুরু করি।
বছরজুড়েই ফরমাশ থাকে। রমজানে বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ইফতার, পায়েস, হালিমের চাহিদা থাকে বেশি। আবার ঈদের সময় অনেকে দেশের বাইরে থাকেন। দেশে থাকা মা-বাবার জন্য বিশেষ দিনটায় ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে চান তাঁরা। তাই ঈদের দিনেও রান্না করি। রমজান ও ঈদের সময়ের এ উপার্জন জমিয়ে প্রতিবছরই কিছু না কিছু করি। গত বছর পথশিশুদের খাইয়েছিলাম। এবারও তেমন ইচ্ছা আছে। সেই সঙ্গে একটা ওভেন কিনব। এটা নিজেকে নিজের ঈদ উপহার!