বিয়ের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় নয়ন সেলিনার স্বামী নিখোঁজ। ছোট্ট দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নেমে পড়েন কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়ার মেয়ে নয়ন সেলিনা। তবে তাঁর লড়াইটা ছিল ব্যতিক্রম।
১৯৯৫ সালে কানের দুল বিক্রির ১৭ হাজার টাকায় সেলিনার বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু। তখন ১০০টি মুরগির বাচ্চা কিনে ছোট্ট একটি কক্ষে গড়ে তোলেন পোলট্রি খামার। ২৩ বছরের মাথায় এসে সেই নয়ন সেলিনা এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক। তাঁর বার্ষিক আয় এখন ছয় লাখ টাকার ওপরে।
অসহায় একজন নারী থেকে কোটিপতি বনে যাওয়া নিয়ে নয়ন সেলিনার বক্তব্যও স্পষ্ট, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়—এ রকম একটা প্রবাদবাক্য সমাজে প্রচলন আছে। ইচ্ছাশক্তির জোরেই তিনি আজকের নয়ন সেলিনা, সফল নারী উদ্যোক্তা হতে পেরেছেন।
১৯৯১ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েই বিয়ের পিঁড়িতে বসেন নয়ন সেলিনা। বিয়ের তিন বছরের মাথায় কোলজুড়ে আসে দুই ছেলে শাকিল শাওন ও সাজিদ মাওন। ১৯৯৫ সালে স্বামী বিদেশে পাড়ি জমান। বিমানে ওঠার পর থেকে আর খোঁজ মেলেনি স্বামীর। তখন ছোট ছেলে মাওনের বয়স ছয় মাস। সম্বল বলতে ছিল এক জোড়া কানের স্বর্ণের দুল। সেই দুল বিক্রি করে পান ১৭ হাজার টাকা। সেই টাকায় কক্সবাজার শহরের ঝাউতলা গাড়ির মাঠ এলাকায় ১ হাজার ৪০০ টাকায় ভাড়া নেন দুই কক্ষের একটি টিনশেড বাসা। একটি কক্ষে গড়ে তোলেন ১০০টি মুরগির পোলট্রি খামার। কয়েক মাসের মাথায় লাভের মুখ দেখতে শুরু করেন। পরিসর বাড়ানোর জন্য দুই বছরের মাথায় কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ঋণ নেন ৪৫ হাজার টাকা। এই ঋণ পেতে তাঁকে নানা ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়েছে। ধীরে ধীরে আয় বাড়তে থাকে নয়ন সেলিনার।
সাত বছরের মাথায় আয়ের কয়েক লাখ টাকায় শহরের দক্ষিণ কলাতলীতে জমি কেনেন ১৬ শতক। সেখানে তৈরি করেন একতলা বসতবাড়ি। বসতভিটায় গড়ে তোলেন বড় ছেলের নামে ‘শাওন পোলট্টি ফার্ম’।
সম্প্রতি বিকেলে খামারে গিয়ে দেখা গেছে, নয়ন সেলিনা নিজেই খামারে মুরগির ডিম সংগ্রহ করছেন। আশপাশের ব্যবসায়ীরা ডিম কিনতে সেখানে ভিড় জমিয়েছেন। খামারের এক পাশে মুরগির শেড, অপর পাশে গরু-ছাগলের খামার। ওপরে কবুতরের শেডঘর। পরম মমতায় তিনি গবাদি পশুপাখির পরিচর্যা করছেন। প্রতিদিন ২৪০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মুরগি ডিম পাড়ে।
নয়ন সেলিনা (৪৫) প্রথম আলোকে বলেন, খামারের আয় থেকে কলাতলীর বাইপাস সড়কে তিন কানি (১২০ শতক) জমি এবং রামুর তুলাবাগান সেনানিবাসের পাশে ৫৪ শতক জমি কিনেছেন। তুলাবাগানে পৃথক জায়গায় একটি মুরগির খামারও গড়ে তুলেছেন তিনি। সেই খামারে আছে সাত হাজার মুরগি। শহরের সমিতি পাড়ায়ও বড় আকারের আরেকটি মুরগির খামার আছে তাঁর। সেখানেও আছে আট হাজার মুরগি। শহরের বড় বাজারে একটি শুঁটকির দোকান ও বাজারঘাটার কোরালরীফ মার্কেটে তাঁর একটি মুঠোফোনের দোকান আছে। দোকান দুটি দেখাশোনা করেন ছোট ছেলে সাজিদ মাওন। তিনি কক্সবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছেন। বড় ছেলে শাকিল শাওন পড়ছেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে।
শহরের বেসরকারি একটি হাসপাতালের নয়ন সেলিনার অংশীদারত্ব রয়েছে। সব মিলিয়ে তিনি এখন কয়েক কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এর মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ আছে প্রায় ৪৫ লাখ টাকার মতো। নয়ন সেলিনা আয়ের টাকা থেকে একটি এতিমখানা পরিচালনাসহ দরিদ্র নারীদের কল্যাণে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন।
সাফল্যের বিপরীতে ইচ্ছাশক্তির কথা তুলে ধরে নয়ন সেলিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর অভাবের সংসারে দিশা হারাইনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কারও দয়ার পাত্র হব না। যত ঝড়ঝাপটা আসুক, পিছপা হব না। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নেমে পড়েছি কাজে।’
এই সফলতা, খ্যাতি এত সহজে ধরা দেয়নি তাঁকে। দীর্ঘ সংগ্রাম, না পাওয়ার বঞ্চনা, প্রতিবেশীদের চোখ বাঁকানো বাঁকা কথাসহ নানা কষ্ট নীরবে সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। হার না মানা উদ্যম আর মেধা দিয়ে সবকিছুকে ছাপিয়ে নয়ন সেলিনা এখন নারী-পুরুষ উভয়ের কাছে ‘আইকন’। খামারি খাতেও সফল একজন নারী উদ্যোক্তা।
নয়ন সেলিনা বলেন, ‘ইচ্ছাশক্তির জোরে এ পর্যন্ত এসেছি। কোনো কিছুরই অভাব নেই। ছেলে দুটো পড়াশোনা করছে।’
সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক, (তৃণমূল নারী উদ্যোক্তা সোসাইটি) গ্রাসরুট, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিসহ সরকারি-বেসরকারি এবং বিদেশি সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃতিস্বরূপ একাধিক সম্মাননা পেয়েছেন নয়ন সেলিনা।
২০১৫ সালে ব্যাংকিং মেলায় সারা দেশের পাঁচজন নারী উদ্যোক্তাকে বাছাই করে সম্মাননা এবং ব্যবসায় লাগানোর জন্য ২৫ লাখ টাকা করে ঋণ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে নয়ন সেলিনা একজন।
গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মাইডাস মিলনায়তনে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
নয়ন সেলিনা দীর্ঘ এই সংগ্রাম শুধু নিজের জন্য করেননি। গত জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ কলাতলীতে নিজের টাকায় গড়ে তোলেন একটি এতিমখানা। সেখানে ৫০ জন এতিম শিশু পড়াশোনা করছে। এতিমদের খাওয়া-দাওয়া, শিক্ষকদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় নির্বাহ করেন তিনি। সমাজের অবহেলিত নারীদের এগিয়ে নিতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। এখন ৫০ জন নারীকে খামারে নিয়োগ এবং শতাধিক নারীকে তিনি হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। কিন্তু অর্থসংকটের কারণে প্রশিক্ষিত নারীরা এগোতে পারছেন না। এ পর্যন্ত তিনি ৫০ জন এতিম ও অসহায় মেয়েকে সম্পূর্ণ নিজের খরচে বিয়ে দিয়েছেন।
স্থানীয় কলাতলী (১২ নম্বর ওয়ার্ডের) পৌর কাউন্সিলর কাজী মোর্শেদ আহমদ বলেন, নয়ন সেলিনা সংগ্রামী এক নারী, যিনি খুবই পরিশ্রম করে এ পর্যন্ত এসেছেন। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, তার জ্বলন্ত প্রমাণ নয়ন সেলিনা। তাঁর দেখাদেখি বহু নারী এই পেশায় আসছেন।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, নয়ন সেলিনা চেম্বারের সদস্য, সফল একজন নারী উদ্যোক্তা। তাঁর মতো বহু নারী চেষ্টা করেও এগিয়ে আসতে পারছেন না একটিমাত্র সমস্যার কারণে। সেটি হচ্ছে এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা ঋণ) ঋণ না পাওয়া। যদিও নারী উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন এসএমই ঋণ দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
একই অভিযোগ করেন নয়ন সেলিনাও। তাঁর ভাষ্য, একজন স্বামী পরিত্যক্তা বা দরিদ্র পরিবারের নারীর আত্মনির্ভরশীলমূলক কোনো কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হচ্ছে অর্থ। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাংক নারীদের হয়রানি করে। মর্টগেজ ছাড়া ঋণ দেওয়া হয় না। মর্টগেজ দেওয়ার মতো সামর্থ্য থাকলে তো ওই নারী আর ব্যাংকে ঋণের জন্য যেত না। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি ব্যাংককে বিনা মর্টগেজে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থার নির্দেশনা দেওয়া উচিত।