ওমর ইশরাক
ওমর ইশরাক

এমটিবি টপ টক

ইংরেজি শিখুন এবং ব্যবহার করুন

বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইনটেলের চেয়ারম্যান বাংলাদেশের ওমর ইশরাক। এ ছাড়া তিনি চিকিৎসা যন্ত্রপাতি তৈরির প্রতিষ্ঠান মেডট্রোনিকের নির্বাহী চেয়ারম্যান। ১১ সেপ্টেম্বর প্রথম আলো ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক আয়োজিত এমটিবি টপ টক অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। অনুষ্ঠানটি প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত হয়। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের প্রধান মুনির হাসান। সেই আলাপচারিতার সংক্ষিপ্ত রূপ থাকছে আজ।

স্কুলজীবন

তৃতীয় শ্রেণি থেকে আমি ঢাকার সেন্ট যোসেফ স্কুলে পড়েছি। এর আগে ঢাকার নীলক্ষেতে একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়েছিলাম। সেন্ট যোসেফ থেকেই আমার মধ্যে মূল্যবোধ গড়ে উঠেছে, প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি হয়েছে। সেখানকার শিক্ষকদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ছোটবেলা থেকে আমি ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছি। তাই লন্ডনে পড়তে যাওয়ার পর ভাষা নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয়নি। ১৯৭৩ সালে আমি দেশ ছেড়েছি, দীর্ঘদিন পরিবারের মানুষকে দেখিনি, আমার মা মারা গেছেন, আমি আসতে পারিনি—এসবই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। পড়ালেখার সঙ্গে মানিয়ে নিতে খুব একটা কষ্ট হয়নি।

কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়া

লন্ডনের কিংস কলেজে আমি স্নাতক হয়ে সোজা পিএইচডি করেছি। পিএচডি শুরু করার দুই বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ইচ্ছে হলো। আমার আগ্রহের বিষয় আলট্রাসনোগ্রাফি। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অধ্যাপকেরই কাজ আছে। তাঁরা বিভিন্ন রাজ্যে (স্টেট) ছড়িয়ে আছেন। এত জায়গায় যাওয়ার মতো পয়সা তো আমার ছিল না। তো আমি ভাবলাম হিচহাইক (চলতি পথে অনুরোধ করে কারও গাড়িতে চড়া বা লিফট নেওয়া) করে দেখি কী হয়। এভাবে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। যাঁরা আলট্রাসনোগ্রাফি নিয়ে গবেষণা করছেন, ঘুরে ঘুরে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতাম, শিখতাম। আমার কাজ নিয়েও আলোচনা করতাম। তখন খুদে বার্তা বা ই-মেইল, কিছুই ছিল না। এমন সব মানুষের সঙ্গে গিয়ে কথা বলতাম, যাঁদের সঙ্গে জীবনে কখনো দেখা হয়নি, কথা হয়নি। শুধু আলট্রাসনোগ্রাফি না, কীভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়, সম্পর্ক তৈরি করতে হয়, কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়, উত্তর দিতে হয়, এসবও শিখেছি। আমার বোন তখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকত। সে বিষয়টা পছন্দ করেনি। ও বলত, এভাবে অন্যের গাড়িতে চড়ে একেক জায়গায় যাওয়া নিরাপদ না। তবে আমার ভাগ্য ভালো কোনো বিপদে পড়িনি। বরং নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি।

প্রকৌশল কাজে লাগিয়ে কীভাবে দেশের উন্নতি করা যায়, মানুষের ভালো করা যায়, এভাবে ভাবলেই ব্যবসায় উন্নতি করা সম্ভব। আমি দেখি, বাংলাদেশে যখন কেউ কোনো প্রতিষ্ঠান গড়েন, তাঁদের প্রথম আগ্রহ থাকে বিদেশে কীভাবে রপ্তানি করব। এটা ঠিক না। বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষ আছে। স্থানীয় বাজার বড় হলে সেখানেই ব্যবসা ভালো হতে পারে। পরে না হয় আপনি রপ্তানির কথা ভাববেন।
ওমর ইশরাক, চেয়ারম্যান অব দ্য বোর্ড, ইনটেল

ইনটেলের চেয়ারম্যান হলাম যখন

সিলিকন প্রযুক্তিতে আমার খুব আগ্রহ। আমি পিএইচডি করেছি সেই ১৯৮১ সালে। সেই সময় থেকে সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি আজ অনেকটা এগিয়েছে। এরপর অনেক কিছুর উদ্ভাবন হয়েছে, কম্পিউটার এসেছে। পিএইচডির পর যখন প্রথম চাকরি খুঁজি, আমি কিন্তু সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে যেতে পারতাম। ইচ্ছাও ছিল। কিন্তু আমি চাকরি পেয়েছি মেডিকেল আলট্রাসাউন্ডে, আর সে বিষয়ে একটু বেশি অভিজ্ঞতাও ছিল। তবে সেমিকন্ডাক্টরে আগ্রহ কখনো হারাইনি। ইনটেলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে এখন শেখার সুযোগ পাচ্ছি, এটাই সবচেয়ে বড় পাওয়া।

বাংলাদেশে গবেষণা ও উদ্যোগের সুযোগ

স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে কম্পিউটারচালিত অ্যাপ্লিকেশন বা সফটওয়্যারের বড় সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি। যেমন বাংলাদেশে আমি দেখেছি, পার্কে মানুষেরা টেবিল নিয়ে বসে থাকে। হাঁটতে গেলে অনেকে রক্ত পরীক্ষা করে, সুগার পরীক্ষা করে। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এই পদ্ধতিটাকে নিশ্চয়ই আরও উন্নত করার সুযোগ আছে। প্রকৌশল শিখে মানুষ যদি উদ্ভাবনের দিকে মনোযোগী হয়ে একটা কিছু বানাতে পারে, তাহলে খুবই ভালো। ভারত কিন্তু সফটওয়্যার খাতে বেশ সফল। বাংলাদেশেও একটু একটু শুরু হচ্ছে। কিন্তু আমি মানুষকে নিজের দেশেই প্রতিষ্ঠান গড়তে উৎসাহ দেব। প্রকৌশল কাজে লাগিয়ে কীভাবে দেশের উন্নতি করা যায়, মানুষের ভালো করা যায়, এভাবে ভাবলেই ব্যবসায় উন্নতি করা সম্ভব। আমি দেখি, বাংলাদেশে যখন কেউ কোনো প্রতিষ্ঠান গড়েন, তাঁদের প্রথম আগ্রহ থাকে বিদেশে কীভাবে রপ্তানি করব। এটা ঠিক না। বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষ আছে। স্থানীয় বাজার বড় হলে সেখানেই ব্যবসা ভালো হতে পারে। পরে না হয় আপনি রপ্তানির কথা ভাববেন।

এগোনোর পথ

আমার নীতি কী, আমি কী করতে চাই, সেটা প্রথমে জানতে হবে। যেই নীতির ওপর ভিত্তি করে আমি আমার জীবন বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করব। কিসে আমি অগ্রাধিকার দেব, আমার কৌশল কী হবে—ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি জানা জরুরি। নীতি, অগ্রাধিকার আর কৌশল—এই তিনটি জিনিস এক করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কৌশল যদি একবার ঠিক হয়, সেটা বারবার পরিবর্তন করা ঠিক না। পথ দেখানোর মতো নীতি বা নির্দিষ্ট কৌশল না থাকলে ধারাবাহিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। আর সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সফল হওয়া খুব কঠিন।

যদি একটি বার্তা দিতে হয়

আমি বলব, নিজের ওপর বিশ্বাস রেখো। বাংলাদেশের একটা সুবিধা আছে, সেটা হলো ইংরেজিতে পড়ার সুযোগ। যে সুযোগটা আমি কাজে লাগিয়েছি। ব্যবসার দুনিয়ায় ইংরেজিতে ঠিকভাবে কথা বলা, বোঝা, নিজের ভাবনাটা উপস্থাপন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে একটা প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থা আছে। সবাইকে আমি বলব, সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে। অনেক দেশ যেমন চীনে এই সুযোগ নেই। সেখানে সরকার থেকে ইংরেজি শিখতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ইংরেজি ভালো জানলে এগিয়ে থাকবে। ইংরেজি শিখুন এবং এটা ব্যবহার করুন।

হতাশা কাটানোর উপায়

কোরআন শরিফেও এ রকম একটা কথা আছে, ‘তুমি তোমার জন্য যেটা খারাপ ভাবছ, হয়তো সেটাই তোমার জন্য ভালো।’ আমি বোধ হয় ঠিকভাবে বলতে পারলাম না, কিন্তু মূল কথা অনেকটা এ রকম। আমি সব সময় বলি, এই কথাটা ভুলো না। যদি কোনো খারাপ সময় আসে, বিশ্বাস রেখো, দিন শেষে হয়তো তোমার জন্য ভালোই হবে। এই বিশ্বাস রাখলে খারাপ সময় পেরিয়ে যাওয়া যায়। মেডট্রোনিকে আমি যখন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলাম, মাসে ১-২ বার শত বা হাজার জনের সামনে বক্তৃতা দিতাম। অনুষ্ঠান শেষে আমি সবার হাতে একটা করে মেডেল দিতাম। এই মেডেলে আমাদের লক্ষ্যের সারমর্মটা লেখা থাকত। ব্যবসায় ভালো দিন আসবে, খারাপ দিন আসবে। সবগুলো দিন কখনো ভালো যাবে না। কিছুদিন দুর্দান্ত কাটবে। কখনো আবার মনে হবে সব ভেঙে পড়ছে। আমরা বলি, সেই সময়টাতে এই মেডেলটার দিকে তাকাবেন, নিজের দূরবর্তী লক্ষ্যটা স্মরণ করবেন।

তরুণেরা সাহায্যের হাত বাড়ান

এ রকম সংকট আমার জীবনে কখনো দেখিনি। কোভিড-১৯ থেকে আশা করি আমরা বের হতে পারব। সবার প্রতি আমার উপদেশ হবে, অন্যকে সাহায্য করুন। যে সুযোগটা আপনি পাচ্ছেন, অনেকে হয়তো সেটা পাচ্ছে না। অন্যকেও সেই সুযোগ পেতে সাহায্য করুন।