‘আর কি কখনো দেখা হবে?’
ভেবে আনমনা হয়ে পড়েছিল তরুণীর দলটা। সংখ্যায় ১৫ জন। একেকজন একেক দেশ থেকে এলেও মাত্র এক মাসেই তাঁরা পরিবার হয়ে উঠেছিলেন। ডিনার সেরে গভীর রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হইহুল্লোড় করছিলেন। রাস্তার পাশে ‘ওয়ান ওয়ে’ লেখা একটা সাইনবোর্ড হঠাৎ মনে করিয়ে দিল, তাঁদের একেকজনের রাস্তা তো আসলে ভিন্ন। মানচিত্র ভিন্ন, পাসপোর্ট ভিন্ন। তরুণীরা প্রতিজ্ঞা করে ফেললেন—‘প্রতিবছর আমরা দেখা করব। কোনো না কোনো দেশে। হোক সেটা ব্রাজিল, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া কিংবা বাংলাদেশ।’
এই তরুণীদের মধ্যে একজন বাংলাদেশি বলেই ‘বাংলাদেশ’ নামটা এল। তিনি আশরীন মৃধা। বিশ্বের নানা প্রান্তে যাঁরা খেলাধুলার মাধ্যমে নারীদের অনুপ্রাণিত করছেন, প্রতিবছর তাঁদের মধ্যে কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানায় যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট। এই প্রকল্পের নাম ‘গ্লোবাল স্পোর্টস মেন্টরিং’। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসগুলো এ বছর ১৫০ জনের নাম প্রস্তাব করেছিল। যাচাই–বাছাই শেষে নির্বাচিত হয়েছেন ১৫ জন।
আশরীন মৃধার অনেক পরিচয়। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় নারী বাস্কেটবল দলে খেলেন, ২০১৬ সালে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। গান করেন। সিলভার লাইট নামে একটি ব্যান্ডের ভোকাল তিনি। কাজ করছেন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারে, সার্ফ এক্সেলের ব্র্যান্ড ম্যানেজার হিসেবে। মেয়েদের বাস্কেটবল খেলায় আগ্রহী করতে তিনি ‘দেশি বলারস’ নামে একটি অলাভজনক সংস্থা গড়ে তুলেছেন।
গত মঙ্গলবার, আশরীন মৃধার গুলশানের অফিসে তাঁর মুখোমুখি বসে মুশকিলেই পড়লাম। কোথা থেকে কথা শুরু করি? করপোরেট দুনিয়া, বাস্কেটবল কোর্ট নাকি গানের মঞ্চ? আশরীন অবশ্য একেবারেই অন্য একটা প্রসঙ্গ বেছে নিলেন। বললেন, ‘সবার আগে বলব আমার পরিবারের কথা।’
জার্সি নম্বর ৮
‘আমার মা রুবিনা কাদের ও বাবা মো. আবদুল কাদের—দুজনই গান করেন। আমি কখনো গান শিখিনি। কিন্তু ছোটবেলায় কীভাবে যেন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান তুলে ফেলতাম। মা-বাবা যখন কোথাও গান করতে যেতেন, অনুষ্ঠানের একটা সময় বরাদ্দ থাকত আমার জন্য।’ মুখের হাসিই বলে দিচ্ছিল, এই স্মৃতি আশরীনের খুব প্রিয়।
গানটা খেলাচ্ছলে শেখা হলেও বাস্কেটবল কোর্টে তিনি শিখে-পড়েই নেমেছেন। খুব ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে পা রেখেছিলেন বাস্কেটবল ফেডারেশনের প্রশিক্ষণ স্কুলে। তখন ঢাকার সানবিমস স্কুলে পড়তেন আশরীন। সিনিয়রদের বাস্কেটবল খেলতে দেখে ছোট্ট মেয়েটার মনে হয়েছিল, ‘ওদের মতো একটা জার্সি যদি আমিও পেতাম!’
অবশেষে ক্লাস ফাইভে উঠলে সানবিমস স্কুলের মেয়েদের বাস্কেটবল দলের ৮ নম্বর জার্সিটা আশরীনের হলো। সে কী রোমাঞ্চ!
দলের নাম বাংলাদেশ
এ লেভেল পেরিয়ে আশরীন মৃধা ভর্তি হন ঢাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে, ২০০৯ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তখন মেয়েদের কোনো বাস্কেটবল দল ছিল না। যে মেয়েরা স্কুলজীবনে ধুন্ধুমার খেলাধুলা করে বড় হয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় পরিসর যেন হঠাৎই তাঁদের গণ্ডিটা ছোট করে দিল। আশরীনের বাস্কেটবল কোর্টের বন্ধুরা তখন একেকজন একেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। সবাই মিলে একদিন ঠিক করলেন, নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা বাস্কেটবল দল তৈরি করবেন।
‘কম্পিউটারের সামনে বসে আমি নিজেই পোস্টার ডিজাইন করলাম। ১০০টা প্রিন্ট করে সাঁটিয়ে দিলাম ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে। পোস্টারের মধ্যে নিজের ফোন নম্বরও দিয়ে দিয়েছিলাম। ছেলেদের কাছ থেকে অনেক উটকো ফোন এসেছে, তবে কাজের কাজ হয়েছে ঠিকই। নর্থ সাউথে আমাদের ১২ জন মেয়ের একটা দল দাঁড়িয়ে গেছে’, বলছিলেন আশরীন।
তখন একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা একসঙ্গে হয়ে বাস্কেটবল খেলতেন, অনুশীলন করতেন। আবার খেলায় ফিরতে পেরে ভালোই কাটছিল আশরীনদের সময়। এর মধ্যে বাংলাদেশ বাস্কেটবল ফেডারেশন থেকে প্রস্তাব এল, নারীদের জাতীয় বাস্কেটবল দল তৈরি করতে চায় তারা। জাতীয় দলে খেলা বলে কথা। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, পড়ালেখার পাশাপাশি এই চাপ নিতে রাজি হননি অনেকে। অবশেষে নানা ঝক্কি পেরিয়ে তৈরি হয় জাতীয় দল। এই দলেও ৮ নম্বর জার্সিটা আশরীন মৃধার।
আশরীন বলছিলেন, ‘২০০৯ সালের শেষ দিককার কথা। ভারতের ত্রিপুরার একটা দলের সঙ্গে আমরা জাতীয় দলের হয়ে প্রথম টুর্নামেন্ট খেলতে নামলাম। প্রথমবারেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। টের পেয়েছিলাম, বাংলাদেশ লেখা জার্সির আবেদন অন্য রকম। খেলা শুরুর আগে প্রথম যেদিন জাতীয় সংগীত শুনেছি, আমাদের দলের সবার চোখে পানি এসে গিয়েছিল।’
যে খেলা স্রেফ শখ ছিল, সেটাই হয়ে গেছে বড় দায়িত্ব। একসময় উত্তরার বাসা থেকে ধানমন্ডির ফেডারেশনে গিয়ে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দুই বেলা অনুশীলন, দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, বিকেলে টিউশনি...ভীষণ পরিশ্রমে কেটেছে সময়টা। জাতীয় সংগীত মনে দাগ কেটেছিল বলেই এই কষ্ট গায়ে মাখেননি আশরীন। ‘দাগ থেকে দারুণ কিছু’ করার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়েছেন তিনি।
ট্রফির অপেক্ষা
সার্ফ এক্সেলের ব্র্যান্ড ম্যানেজার আশরীন মৃধার একটি পরামর্শ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরা টুকে নিতে পারেন—‘পড়ালেখার পাশাপাশি যদি আর কিছু না-ই করি, ইন্টারভিউ বোর্ডের লোকজনের সঙ্গে আমি কী নিয়ে গল্প করব? স্কুলে পড়েছি, ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি...এগুলো তো সবাই বলে।’ কথাটা তিনি মন থেকে বিশ্বাস করেন বলেই গান, খেলাধুলা, পড়ালেখা—সব চালিয়ে গেছেন সমান তালে। ২০১৩ সালে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারের সঙ্গে যাত্রা শুরু হয়েছিল শিক্ষানবিশ হিসেবে। যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে একটু একটু করে এগিয়েছেন। খেলাধুলা বা গানের প্রতি তাঁর আগ্রহকে সব সময় সমর্থন দিয়েছে ইউনিলিভার।
গত অক্টোবরে মাসব্যাপী গ্লোবাল স্পোর্টস মেন্টরিং প্রকল্পে অংশ নিয়ে আশরীনের দেখার চোখটাই বদলে গেছে। নারীদের ক্রীড়াবিষয়ক ওয়েবসাইট ইএসপিএনডব্লিউ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেনেসিও ছিল এই প্রকল্পের সঙ্গে। দারুণ সব অভিজ্ঞতা জমা হয়েছে জাতীয় দলের এই খেলোয়াড়ের ঝোলায়। একেবারে সামনের সারিতে বসে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বাস্কেটবল অ্যাসোসিয়েশনের তিনটি ম্যাচ দেখেছেন তিনি। কীভাবে তাদের আয়োজনটা জমজমাট হয়, কেমন করে তারা দর্শকদেরও খেলার ফাঁকে ফাঁকে নানা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত করে, খেলোয়াড়রা অনুশীলনে কী কী করেন—মনোযোগী ছাত্রের মতো সব টুকে এনেছেন আশরীন।
এবার শিক্ষাটা প্রয়োগের পালা। মেয়েদের বাস্কেটবল খেলায় অনুপ্রাণিত করতে ‘দেশি বলারস’ নামে একটি সংস্থা গড়েছিলেন আগেই। ফেসবুক পেজের মাধ্যমে এখন জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন। আশরীন বলেন, ‘আমি চাই, বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগে মেয়েদের একটা করে বাস্কেটবল দল গড়ে উঠুক। ক্রিকেট ও ফুটবলে আমাদের মেয়েরা ভালো করছে। বাস্কেটবলে কেন নয়? ২০১৬ সালে সাউথ এশিয়ান বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়নশিপে আমরা ভালো খেলেছি, কিন্তু ট্রফি আনতে পারিনি। আমাদের একটা ট্রফি দরকার।’
সব শেষে একটা মজার তথ্য দিয়ে শেষ করি। বাস্কেটবলের সঙ্গে এতই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে আশরীনের জীভন, গত বছর ডিসেম্বরে তাঁর বিয়ের গায়ে হলুেদর অনুষ্ঠানও হয়েছে সানবিমস স্কুলের বাস্কেটবল কোর্টে! আশরীনের স্বামী ইব্রাহিম মোহাম্মাদও বাস্কেটবল খেলেন।