তারুণ্যের জয়োৎসব

আশাজাগানিয়া তরুণ দল

দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন এই তরুণেরা
দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছেন এই তরুণেরা
ক্রাউন সিমেন্ট-প্রথম আলো তারুণ্যের জয়োৎসবে অংশ নিয়েছেন সারা দেশের তরুণেরা। পেয়েছেন ক্যারিয়ারবিষয়ক দিকনির্দেশনা। আঞ্চলিক পর্যায়ে ৩২টি আয়োজনের পর গত ২৪ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় পর্ব। জাতীয় পর্বে আমন্ত্রিত বক্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলেছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা, এ সময়ের তরুণদের নিয়ে তাঁদের স্বপ্নের কথা।

আরও বেশি যুক্ত থাকতে চাই

মাহমুদ হোসেন

চিফ বিজনেস অফিসার, গ্রামীণফোন

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশের শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে তরুণেরা ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা সঠিকভাবে পান না। সেতারুণ্যের জয়োৎসবের মতো উদ্যোগ খুবই প্রয়োজন। আয়োজনটিকে আরও ফলপ্রসূ করতে হলে আমার পরামর্শ হলো—আঞ্চলিক পর্যায়ে অনেক বেশিসংখ্যক তরুণকে বিভিন্ন দক্ষতার ওপর হাতে-কলমে ধারণা দেওয়া। এ ক্ষেত্রে কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য ভিডিও টিউটোরিয়াল/প্রশিক্ষণের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। আমি বিশেষ করে চারটি দক্ষতার কথা উল্লেখ করতে চাই, যেগুলো তরুণদের ভবিষ্যতের প্রেক্ষাপটে তৈরি হতে সাহায্য করবে—সৃজনশীলতা, পরস্পর সহযোগিতা, যোগাযোগ ও তুরীয় চিন্তা (ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং)। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত সিএসআর (করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা) হিসেবে আঞ্চলিক আয়োজনে যোগ দিতে পারেন। তারুণ্যের জয়োৎসব এবং এ ধরনের আয়োজনের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত থেকে আমি আমার পেশা ও সামাজিক জীবনের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নিতে চাই।

কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে

এ বি এম ইউসুফ আলী খান

মহাব্যবস্থাপক, মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগ, ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপ

এই অনুষ্ঠানের সুযোগে আমি বেশ কয়েকটা জেলায় ঘুরে তরুণদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি, সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। সর্বশেষ জাতীয় পর্বে ‘উপস্থাপন করো নিজেকে’ শীর্ষক অধিবেশনে আলোচনাটা এত জমে উঠেছিল যে মনে হচ্ছিল এই বিষয়েই দিনব্যাপী একটা অধিবেশন হতে পারে। আমরা তাদেরকে বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রের কথা বলছি, কিন্তু আমরা কীভাবে তাদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে পারি, সেটাও ভাবতে হবে। আমার পেশাগত জায়গা থেকে আমি মনে করি, একসঙ্গে এত শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা না বলে ‘ওয়ান টু ওয়ান সেশন’ হলে তরুণেরা আরও উপকৃত হতো। ভবিষ্যতে আমরা হয়তো এই জায়গাটাও ভেবে দেখব।

তরুণদের চোখে আলো দেখেছি

স্বপ্না ভৌমিক

কান্ট্রি ম্যানেজার, মার্ক্স অ্যান্ড স্পেন্সার বাংলাদেশ

সেদিন গাড়ি থেকে নামার পর আমার মনে হলো, একটা মেলা দেখতে পেলাম। তরুণদের মেলা। ভেতরে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র কাজ করছে কি না, বসার জায়গা আছে কি না, ওরা এসবের কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেনি। ওরা এসেছে কথা শুনতে। এ রকম আয়োজন কখনো দেখিনি। আমি যে অধিবেশনটিতে ছিলাম, সেটির নাম বিশ্বের হাতছানি। পরিশ্রম করলে যে করপোরেট দুনিয়ায় একটা ভালো অবস্থানে পৌঁছানো যায়, সেটা বলতে গিয়ে আমরা আমাদের গল্পগুলো ভাগাভাগি করে নিয়েছি। তরুণদের চোখে আমি যে আলো দেখেছি, সেই আলো দেখে আমার মনে হয়েছে এটাই বাংলাদেশ। শুধু নিজের অধিবেশনটিতেই নয়, আমি পরের অধিবেশনেও ছিলাম। খুব ভালো লেগেছে। আমি নিজেও ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছি।

সবাইকে গ্র্যাজুয়েশন করতে হবে, তা নয়

গাউসুল আজম শাওন

ম্যানেজিং পার্টনার, গ্রে অ্যাডভার্টাইজ লিমিটেড

আজকে বাংলাদেশ নিয়ে বহির্বিশ্বে যা কিছু ভালো কথা হয়, তার একটা বড় কৃতিত্বই আমাদের তরুণদের। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে মনে হয়েছে, ওরা এখনো ঠিক জানে না যে ওরা কী করতে চায়। কিন্তু সে জানতে চায়, কোথাও পৌঁছাতে চায়। আমি মনে করি, সবাইকে যে গ্র্যাজুয়েট হতে হবে তা নয়। যারা বাংলাদেশকে তৈরি করবে, তাদের মধ্যে কিন্তু শুধু স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী থাকলে হবে না। কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন লোক লাগবে। কে খুব ভালো মোটর মেকানিকস বোঝে, কে ভালো সফটওয়্যার বোঝে, কে খুব ভালো নার্সিং জানে...তাদেরও আমাদের দরকার। আমাদের দেশে একটা ধারণা ছিল যে কিছু কাজ খুব সম্মানের আর কিছু কাজ সম্মানের নয়, এটা থেকেও বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। এই প্রজন্মই সেটা পারবে।

তরুণেরা নিজেকে বদলাতে আগ্রহী

জাবেদ পারভেজ

ভাইস প্রেসিডেন্ট, রবি আজিয়াটা লিমিটেড

আঞ্চলিক আয়োজনগুলোর কয়েকটিতে আমি গিয়েছি। ময়মনসিংহ, নরসিংদীতে দেখেছি, অনেকে দূরদূরান্ত থেকে এসেছে, অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর আমাদের সঙ্গে কথা বলেছে। ওদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, ওরা নিজেকে বদলাতে আগ্রহী। সেই দিক থেকে আমাদের দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। ওদের জায়গা থেকে ওরা এগিয়ে আসছে, এখন আমাদেরও তো কিছু করা উচিত। কীভাবে কেবল একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নয়, দীর্ঘ মেয়াদে তরুণদের পাশে থাকা যায়, সেটি আমাদের ভাবতে হবে। আমার জায়গা থেকে যতটা সম্ভব আমি সাহায্য করতে চাই। তরুণেরা যেন কোথাও থেকে একটা কিছু দেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে না ফেলে। বরং নিজের পরিবার, নিজের শক্তি, নিজের জীবনের সঙ্গে মানানসই একটা কিছু করে সফল হতে পারে।

নেটওয়ার্কিংয়ের বড় সুযোগ

রেদওয়ান রনি

নির্মাতা

এসব আয়োজনে আসলে বক্তাদের কথা শোনার চেয়েও বড় বিষয় হলো নেটওয়ার্কিং করার সুযোগ। এতজন তরুণ, যারা ভালো কিছু করতে চায়, যারা ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছে, এরা তো সচরাচর একসঙ্গে হওয়ার সুযোগ পায় না। এই সুযোগটা কে কতটুকু কাজে লাগাতে পারল জানি না। তবে আমার মনে হয়, এখানে টানা সেশন না হয়ে যদি প্রতিটি সেশনের পর নিজেদের মধ্যে কথা বলার একটা সুযোগ থাকত, তাহলে আরও ভালো হতো। ধরুন, নিজেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল, আড্ডাবাজিও না হয় করল, এসবের মধ্য দিয়েই কিন্তু ভালো আইডিয়া বের হয়ে আসে। আরেকটা বিষয় হলো, এই তরুণেরা নিশ্চয়ই নিবন্ধনের মধ্য দিয়ে এখানে এসেছে। এদের সঙ্গে যদি ভবিষ্যতেও যোগাযোগ রাখা যায়, তাদের ক্যারিয়ারের দিকনির্দেশনা দেওয়া যায়, তাহলে ভালো হয়।

সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব আছে

তাহমিদ আরিফ

প্রোগ্রাম অফিসার, স্কিলস ২১, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা।

 ‘আমি দ্বিতীয় হিটলার হতে চাই’ একজন উজ্জীবিত তরুণের এ রকম আকাঙ্ক্ষা শোনার পর কিছুটা অবাক হলেও পরবর্তী সময়ে তার এই উক্তির ব্যাখ্যা আমাদের চমকে দেয়। দেশের জন্য, মানবতার জন্য এবং নিজেকে সে অনুযায়ী দক্ষ করে তোলার অভিপ্রায় প্রতিটি তরুণের মধ্যে পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে পারি। যদিও ‘আপনারা আমাদের কী দেবেন? এখান থেকে কী পাব?’ এসব প্রশ্নে প্রথমে হতাশ হলেও, পরে বুঝতে পারি যে আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় ক্যারিয়ারবিষয়ক সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব থাকায় অনেকে এমন প্রশ্ন করে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন তরুণ দলের সঙ্গে ক্যারিয়ারবিষয়ক আলাপে জানাতে পারি, পেশাগত বিষয়ে তাদের জানার কত আগ্রহ। যদিও বেশির ভাগই জীবনে উদ্যোক্তা হতে চেয়েছে কিন্তু কবি বা সমাজসেবক হতে চাওয়া বা সমাজ পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখা তরুণের সংখ্যাও কম নয়।

এখনো আমাদের মধ্যে রোমাঞ্চ আছে

মেহেদী হক

কার্টুনিস্ট ও ঢাকা কমিকসের প্রতিষ্ঠাতা

সংগীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এখনকার সময়ে আমাদের অভাবের বড় অভাব।’ কথাটা খুব ভালো লেগেছিল। তিনি বলতে চাচ্ছিলেন, আমরা সবকিছু এত হাতের কাছে পেয়ে যাই যে আমাদের জীবনের রোমাঞ্চ কমে গেছে। তারুণ্যের জয়োৎসবে গিয়ে মনে হলো না, এখনো আমাদের মধ্যে রোমাঞ্চ আছে। ঢাকার বাইরে থেকে এই যে এত তরুণ এতটা আগ্রহ নিয়ে এসেছে, এটা তো একটা দারুণ ব্যাপার। এ ধরনের আয়োজনে এসে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়, বর্তমান সময়ের চাহিদা সম্পর্কে জানা যায়, একজন তরুণ বুঝতে পারে যে আমার কোথায় কোথায় উন্নতি করা দরকার। শুধু অনুপ্রেরণা দিলেই হয় না। পেশাগত পরামর্শও কখনো কখনো কাজে লাগে। যেমন আমি খুব ভালো আঁকতে পারি, কিন্তু এই দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ক্যারিয়ার গড়ব কীভাবে? এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য একটা পোর্টাল থাকলে খুব ভালো হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিডিও (www.prothomalo.com) দেখুন প্রথম আলো অনলাইন ও তারুণ্যের জয়োৎসবের ফেসবুক পেজে (www.fb.com/amadertarunno/)