আলোদূষণ: বাড়ছে ওজন, ক্যানসারের ঝুঁকি

অন্ধকারের জীবন বলতে এখন আর কিছু নেই। ছবি: দীপু মালাকার
অন্ধকারের জীবন বলতে এখন আর কিছু নেই। ছবি: দীপু মালাকার

১৯৯৪ সাল। মেঘমুক্ত এক রাত। লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে ভোরের আগে ভূমিকম্প হলো। ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, কেবল শহরজুড়ে কিছুক্ষণ বিদ্যুৎ ছিল না। সদ্য কাঁচা ঘুম থেকে উঠে চমকে যাওয়া কিছু নাগরিক বিভিন্ন জরুরি বিভাগে ফোন করা শুরু করল। মাথার ওপরে এক রহস্যময় উজ্জ্বল মেঘ দেখে তারা ভীত!

পরে জানা গেল, সেই রহস্যময় উজ্জ্বল মেঘ আসলে আকাশগঙ্গা, যে গ্যালাক্সি মানে ছায়াপথে আমাদের সৌরজগৎ, আমাদের পৃথিবীর অবস্থান। কৃত্রিম নাগরিক আলোর আবরণে ঢাকা পড়ে যাওয়া অন্ধকার আকাশে নক্ষত্রদের দেখতে পায় না আর শহরের মানুষেরা। এখন তারা কখনো বিদ্যুৎ–বিভ্রাটে অন্ধকারের সুযোগে রাতের আকাশ দেখলে ভয় পেয়ে যায়।

বিদ্যুৎ আর বৈদ্যুতিক আলো মানুষের অন্যতম বড় আবিষ্কার। এই আবিষ্কার আমাদের গ্রহকে এমনভাবে পাল্টেছে, যা এর ৪০০ কোটি বছরের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি। পৃথিবীর বিশাল অংশ থেকে রাত্রির স্বাভাবিক অন্ধকার হারিয়ে গেছে। রাত্রির যে অন্ধকার সন্ধ্যার পর থেকে পৃথিবীকে কালো চাদর টেনে দেয়, পৃথিবীর প্রাণীদের জীবনচক্রে তার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এখন আমরা সন্ধ্যার পর কাজ করি। অন্ধকারের জীবন বলতে এখন আর কিছু নেই। এই আলোকময় জীবনের এক অন্ধকার দিক আছে।

যে বাড়তি আলো আমরা পরিবেশে জমা করছি, তা পৃথিবীর পরিবেশচক্রকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। যেসব প্রাণীর জীবনচক্র অন্ধকার অবলম্বন করে টিকে থাকে, তারা হুমকির মুখে আছে। আমাদের নিজ শরীরের একটা প্রাণরাসায়নিক ছন্দ আছে। আলো আর অন্ধকারের তালে তালে সেই ছন্দ জোয়ার আর ভাটার মতো ওঠানামা করে। দিন আর রাতকে এক করে ফেলে সেই ছন্দকেও আমরা বদলে দিয়েছি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝেছিলেন পৃথিবীর গতি আর ঋতুচক্রের রহস্য। বুঝতে পেরেছেন কখন ফসল বুনতে আর কাটতে হবে। নক্ষত্রমণ্ডলী নিয়ে গড়ে উঠেছে কত বিচিত্র গল্প! আমরা অন্ধকার রাতের আকাশের সেই অতি আপন আদি সম্পর্ক হারিয়েছি।

রাসায়নিক বা পারমাণবিক দূষণের মতো এখনো এত গুরুত্ব না পেলেও আলোকদূষণ পৃথিবীতে এক সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে সতর্ক করে দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সুওমি এনপিপি স্যাটেলাইটের পর্যবেক্ষণ বলে যে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখন আর আকাশগঙ্গা ছায়াপথ দেখতে পায় না। পৃথিবীর কিছু অতি আলোকিত জায়গা, যেমন সিঙ্গাপুর, কুয়েত, সান মারিনোতে যেসব নক্ষত্র আমরা খালি চোখে দেখতে পাই, তার প্রায় ৯৯ দশমিক ৫ শতাংশ নক্ষত্র আর দেখা যায় না। ২০১৭ সালের এক গবেষণা বলছে যে ২০১২ থেকে ২০১৬ সালে আলোকদূষণ দুই শতাংশ হারে বেড়েছে। অন্য সব বিবেচনার পাশে এ–ও মনে রাখা দরকার যে এই অধিক আলোর বিশাল অংশই জ্বলে বাহ্যত অকারণে। এই সমস্যা অন্যভাবে মোকাবিলার চেষ্টাও চলছে। লস অ্যাঞ্জেলেস শহর দেড় লাখ রাস্তার বাতি এলইডি বাল্ব লাগিয়ে বছরে প্রায় ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করেছিল। কিন্তু ব্যয় কম হচ্ছে বলে আবার বেশি বাতি আর অকারণে বাতি জ্বালিয়ে রাখার প্রবণতাও বাড়ল। এই এলইডি বাল্বের সাদা আলো নীল আলোকতরঙ্গ ছড়ায়। সেই তরঙ্গ পরিবেশে ছড়ায়। এতে আকাশের মাঝে আলোর আভা বাড়ে। এই আলোকতরঙ্গ পশুপাখিসহ মানুষের ক্ষতি করে অন্য সব আলোকতরঙ্গের চেয়ে অনেক বেশি।

লাখ বছর ধরে দিন আর রাতের ছন্দময় আসা-যাওয়া আমাদের শরীরের সঙ্গে মনকেও নিয়ন্ত্রণ করেছে। আমাদের শরীর এক নিয়মিত লয়ে চলেছে। রাতে ঘুম, দিনে জাগা আর কাজ—এইভাবে আমাদের বিবর্তন ঘটেছে। এখন আমরা গত প্রায় শত বছরে এই ছন্দোবদ্ধতা হারিয়েছি। কানেটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ের রিচার্ড স্টিভেন্স বলছেন, ‘রাতের শারীরবৃত্ত চায় অন্ধকার। আমাদের এখন দরকার আরও দীর্ঘ শারীরবৃত্তিক রাত্রির অন্ধকার।’

এই আলোকময় জীবনের এক অন্ধকার দিক আছে। ছবি: দীপু মালাকার

আলোর সঙ্গে আমাদের শরীরের সরাসরি সম্পর্ক আছে। আলোর ফোটন কণা আমাদের চোখের রেটিনায় গিয়ে পড়ে। ফলে সিগন্যাল গিয়ে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনে পৌঁছায়। ওই বিশেষ নিউরনগুচ্ছ মস্তিষ্কের পিনিয়াল গ্ল্যান্ডের অন্যতম প্রভাবক। এই গ্ল্যান্ড থেকে মেলাটনিন হরমোন তৈরি হয়। এইভাবে মেলাটোনিন স্বাভাবিকভাবে সূর্যাস্তের সময় তৈরি শুরু হয়ে মাঝরাত নাগাদ তুঙ্গে পৌঁছায়। এই হরমোনের কাজ হচ্ছে আমাদের ঘুম-জাগরণের বৃত্ত, শরীরের অধিক তাপ কমানো, বিপাক প্রক্রিয়া বা ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ—এই সব ঠিক রাখা। মাঝ রাতে খিদে পাওয়ার মতো ঘটনা আমাদের এক শ বছর আগের পূর্বপুরুষেরা জানতেন না। এসব এখন ঘটছে দিন–রাতের ছন্দ এলোমেলো হয়ে মেলাটোনিন হরমোনের বিপর্যয়ের ফলে। কম্পিউটারের স্ক্রিন, বাথরুমের উজ্জ্বল আলো, রাস্তার অতি উজ্জ্বল আলো, ঘরের বা বাইরের বৈদ্যুতিক আলো—এর সবই মেলাটোনিনের স্বাভাবিক নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত করে। এ ঘটনার এক অন্যতম ফল হচ্ছে ওজন বেড়ে যাওয়া। ধারণা করা হচ্ছে, এর আরও ফলাফল হিসেবে হৃদ্‌রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, অবসাদ বাড়ছে। এসব প্রবণতা বেশি দেখা যায় রাতের শিফটে কাজ করা কর্মীদের মধ্যের। ২০০৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রাতে কাজ করাকে ক্যানসারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে। আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ২০১২ সালে বলেছে যে রাতের বেলা অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার শরীরের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। আর লাখ বছরে মানুষের শরীর ও মন আলো–অন্ধকারের ছন্দে নিজের যে জগৎ তৈরি করেছে, তাকে এক শ বছরে পাল্টে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

বিভিন্ন সূত্র অবলম্বনে লেখা।