দূরপাল্লার বাস। নারী যাত্রী তার কিশোরী কন্যাকে নিয়ে ঘুমে কাদা। মা-মেয়ের পায়ের কাছে আরেক কিশোরী। সরু জায়গায় কোনো রকমে তার শরীরটি রেখেছে। গৃহকর্মী কিশোরীর জন্য আলাদা করে টিকিট কাটেননি গৃহকর্তা, জড়সড় হয়ে পায়ের কাছে বসেই তাকে এতটা পথ ভ্রমণ করতে হয়েছে। এমন অমানবিকতার চিত্র বছর দুই আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। ছবিটা দেখে মাথায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার পঙ্ক্তি ঘুরপাক খেয়েছিল, ‘আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি/ তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা আরও দেখেছি, রেস্তোরাঁয় নিজ সন্তানের প্লেট উপচানো খাবার কিন্তু এক কোনায় দাঁড়ানো গৃহকর্মী শিশুটির হাতে দুটি মাত্র ফেঞ্চফ্রাই। আবার রিকশার আসনে বসা বাড়ির লোকেরা আর রিকশার পেছনে ঝুলন্ত দাঁড়ানো অবস্থায় গৃহকর্মী। এমন অমানবিকতায় মানবিক হৃদয়গুলো দুমড়েমুচড়ে ওঠে। এমন দৃশ্যের সঙ্গে বছরজুড়ে পত্রিকার পাতায় দেখা যায় গৃহকর্মী নির্যাতনের আরও ভয়াবহ খবর।
নির্যাতনের শিকার যেমন গৃহকর্মীরা হন, তেমনি গৃহকর্মী দ্বারাও তাঁদের তত্ত্বাবধানে রেখে যাওয়া শিশুদের নির্যাতনের ঘটনা, ভিডিও ফুটেজ দেখে আমরা আঁতকে উঠি। নির্যাতিত হবে না গৃহকর্মী, নির্যাতনের শিকার হবে না কর্মজীবী মায়ের শিশুটিও—এমন সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ, পরিবার পেতে কী করতে পারি?
এমনই এক ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর উত্তরায়। ১১ জুন ১৮ বছরের গৃহকর্মী নিয়াসার গায়ে গরম ভাতের মাড় ছুড়ে দেন গৃহকর্তার কন্যা। তার অপরাধ ছিল ‘ভাত এখনো হয়নি, চুলায়’—এটা বলা। নিয়াসা এখন বার্ন ইউনিটে ভর্তি, তার চিকিৎসা চলছে। নিয়াসা তো প্রাণে বেঁচে গেছে। এমন ঠুনকো ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়েছে শত শত নিয়াসার, যাদের খবর আমাদের সামনে আসেনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে মোট ৪৪ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এঁদের মধ্যে চারজনকে হত্যা করা হয়েছে। ১২ জনের হয়েছে রহস্যজনক মৃত্যু, ধর্ষণের শিকার ১২ জন, শারীরিক আঘাত ও নিপীড়নের শিকার ১২ জন এবং নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন ৪ জন। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মোট ১৩ জন গৃহকর্মী নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এঁদের মধ্যে চারজন নিহত হয়েছেন। নিহত গৃহকর্মীদের মধ্যে তিনজনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। এছাড়াও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন দুজন।
প্রতিবছর জরিপে উঠে আসে এমন তথ্য। কিন্তু এরপরও তো থেমে নেই নির্যাতন। অমানবিকতার প্রতিচ্ছবি। গৃহকর্মী নির্যাতন এবং সম্প্রতি ঘটে যাওয়া উত্তরার এমন বীভৎসতা নিয়ে বেসরকারি সংস্থা কর্মজীবী নারীর সভাপতি শিরিন আখতার বলেন, ‘এই যে গৃহকর্মীরা যাঁদের বাসায় থাকেন, তাঁরা হয়তো উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত; মোটকথায় তাঁরা শিক্ষিত। শিক্ষিত মানুষ যদি এমন আদিম মানুষের মতো আচরণ করেন, আমরা তাহলে কোথায় যাব? তাঁরা কেন এমন অমানবিক ঘটনা ঘটাবেন? এরপরও ঘটছে। আমরা সোচ্চার হচ্ছি। প্রতিটি ঘটনায় প্রতিবাদে একত্র হচ্ছি। তাও তো থেমে থাকছে না এমন ঘটনা।’
২০১৫ সালে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতিমালা আইন অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। নীতিমালায় গৃহকর্মীদের সুবিধার জন্য হেল্প লাইন চালুসহ ১৪ বছরের নিচে কাউকে গৃহকর্মী নিয়োগ দেওয়া যাবে না। তাঁদের শ্রমঘণ্টা এবং বেতন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করার মতো অধিকার নিশ্চিতের কথা বলা হয়। নীতিমালা অনুমোদন পাওয়ায় শ্রম আইন অনুযায়ী গৃহকর্মীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা। গৃহকর্মীদের নির্যাতন করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নেবে।
‘কিন্তু যখন আইনি প্রক্রিয়ায় আমরা যাই, তখন দেখা যায় দুই পরিবার সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি মিটমাট করে ফেলে। তখন আর আইনের প্রয়োগ হয় না। সামাজিক সচেতনতা ও নজরদারির মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটি চালিয়ে নিতে হবে’, এমনটাই মনে করেন শিরিন আখতার।
রাজধানীতে গৃহকর্মী বেশি প্রয়োজন হয় কর্মজীবী পরিবারের সন্তানদের দেখাশোনার জন্য। নির্যাতনের শিকার যেমন গৃহকর্মীরা হন, তেমনি গৃহকর্মী দ্বারাও তাঁদের তত্ত্বাবধানে রেখে যাওয়া শিশুদের নির্যাতনের ঘটনা, ভিডিও ফুটেজ দেখে আমরা আঁতকে উঠি। নির্যাতিত হবে না গৃহকর্মী, নির্যাতনের শিকার হবে না কর্মজীবী মায়ের শিশুটিও—এমন সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ, পরিবার পেতে কী করতে পারি? প্রশ্ন ছিল গৃহ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আমার আস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারীয়াত রহমানের কাছে। তিনি বলেন, ‘তিন বছর ধরে আমাদের প্রতিষ্ঠান নার্স, ন্যানি-বেবিসিটার দিয়ে আসছে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা যাদের পাঠাচ্ছি, তাদের কাছে রোগী, শিশুরা যেন যত্ন পায়—এটা আমরা নিশ্চিত করি। সেবাদানকারী প্রত্যেকেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। বাংলাদেশে যদি এমন প্রতিষ্ঠান হয় যে তারা গৃহকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাসায় পাঠানোর সেবাটি নিশ্চয়তা দেন, তাহলে মানুষের ভোগান্তি কমে এবং গৃহকর্মী নির্যাতনের বিষয়টিও তখন এতটা ভয়াবহ থাকবে না।’