ঘোরাঘুরি

আরেক বিছনাকান্দি

উৎমাছড়া যেন নতুন এক বিছনাকান্দি। ছবি: লেখক
উৎমাছড়া যেন নতুন এক বিছনাকান্দি। ছবি: লেখক
রূপবৈচিত্র্যে উৎমাছড়াকে বলা যায় বিছনাকান্দির সখা। অবস্থান সিলেট জেলাতেই। তবে উৎমাছড়ার কপালে বিছনাকান্দির মতো পরিচিতি জোটেনি এখনো। ঘুরে এসেছেন আনিস মাহমুদ


উঁচু উঁচু পাহাড়ের ভাঁজে সবুজের আস্তর। সেই সবুজ পাহাড়ের বুক বেয়ে নেমে এসেছে সরু ঝরনা। কলকল করছে শীতল স্বচ্ছ জলরাশি। হরেক রঙা পাথর ছড়ানো সর্বত্র। আকাশে কখনো ঘোলা মেঘ, কখনো নীলের ছায়া। উৎমাছড়ায় পৌঁছে প্রথম দেখায় মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, আহ্, কী সুন্দর!

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে সবে। সাত বন্ধু মিলে পথ ধরলাম উৎমাছড়ার। সিলেট শহর থেকে অটোরিকশায় উমাইরগাঁও যেতেই হেমন্তের সকাল স্বাগত জানাল। চা-বিরতির পর ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রওনা হলাম উৎমাছড়ার দিকে। জায়গাটা সিলেটের ভারত সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। ভাঙা সড়ক। ভোগান্তিও কম নয়, তাই বেছে নেওয়া নৌপথ। ভাদেশ্বরা নদীতে নৌকায় বসে দূর পাহাড়ের দৃশ্য দেখে বিরামহীন আড্ডায় আমাদের নৌকা তখন পাথরচাউলী হাওরে। হাওরের দুধারে কাশবন। তবে শরতের কাশফুল ঝরে ন্যাড়া মাথায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ছোট ছোট নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন মৎস্যজীবীরা। জেলেদের অবাক দৃষ্টি আমাদের নৌকার দিকে! হেমন্তের স্নিগ্ধ সকালে তখন কিছুটা কড়া রোদ। সীমান্তের উত্তর-পূর্ব দিকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদল করছে। দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে যাই কোম্পানীগঞ্জ বাজারে।

নৌকার মাঝি ধলাই নদ ধরে যাচ্ছেন দয়ারবাজার ঘাটে। গন্তব্য এবার সরাসরি উৎমাছড়া। নৌকা যত এগোচ্ছে দৃষ্টিসীমায় তখন মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়। এ পথ দিয়েই যেতে হয় ধলাই নদের উৎসমুখ ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরে। সাদা পাথর এলাকায় যাওয়ার আগেই নেমে পড়লাম দয়ারবাজার ঘাটে। অটোরিকশায় করে যেতে হবে এবার চড়ারবাজার।

ভাঙা সরু পথ দিয়ে বাউলগান গেয়েই চলেছি আমরা। দুই পাশের ধানখেতে চড়ুই-টিয়ার ওড়াউড়ি। চোখ বন্ধ করে আমন ধানের কাঁচা-পাকা ঘ্রাণ নিতে নিতে অবস্থান চড়ারবাজার। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, এবার ১৫ মিনিটের হাঁটা রাস্তায় পৌঁছে গেলাম সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলার উত্তর রনিখাই গ্রামের উৎমাছড়া। গ্রামের বাড়িগুলো বেশ চোখে লাগার মতো। হাঁটুপানিতে নেমে পাথর আর কয়লা সংগ্রহ করছে গ্রামের মানুষ। মানচিত্র বলছে, ভারতের চেরাপুঞ্জির ঠিক নিচেই অবস্থান সিলেটের অন্যতম সুন্দরতম এই স্থানটির। বৃষ্টির জন্য তো চেরাপুঞ্জির নাম সবার ওপরে। তাই বর্ষার সময় এখানেও এই রোদ, এই বৃষ্টি।

নীল পাহাড়ের পটভূমিতে কাশবন

সঙ্গীদের ক্লান্ত চোখ-মুখে এবার প্রশান্তির আভা। রূপ-লাবণ্যে উৎমাছড়া পরতে পরতে সাজিয়ে রেখেছে মনমাতানো সৌন্দর্য। পাহাড়ের গায়ে সবুজের সমারোহ, পাথর ছড়ানো চারপাশ, ছোট-বড় অসংখ্য পাথর। ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ের কোলঘেঁষা ছড়ায় আছড়ে পড়ছে দুধসাদা জলরাশি। আমরাও দল বেঁধে শীতল জলে গা ভাসিয়ে দিলাম। সীমান্তের ওপারে চোখে পড়ে ঝুলন্ত সেতু। সেতুর নিচ দিয়েই বয়ে আসছে ঝরনার পানি। হিমশীতল পানিতে ভিজে কাঁপছে সবাই। ছড়ার কোলে দাপাদাপি গল্প-আড্ডায়, দিনের আলো কখন যে পাহাড়ের ওপারে হেলান দিয়েছে টেরই পাইনি। হেমন্তের ছোট দিনে অন্ধকার জেঁকে বসার আগেই উতলা মনকে বশ মানিয়ে উৎমাছড়ার অসম্ভব সুন্দরকে বিদায় জানিয়ে ফিরতে শুরু করি। দলের কেউ কেউ গুনগুনিয়ে গাইছে, ‘ধনধান্য পুষ্পভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা...।’

যেভাবে যাবেন

দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে সুবিধামতো বাহনে সিলেট আসতে হবে। সিলেট শহর থেকে উৎমাছড়ায় সড়ক ও নৌপথে যাওয়া যায়। সড়কপথে যেতে সিলেট শহরের আম্বরখানা থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় প্রথমে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে যেতে হবে। ভাড়া নেবে জনপ্রতি ২৫০ টাকা। ভ্রমণসঙ্গীর সংখ্যা বেশি থাকলে সরাসরি অটোরিকশা বা লেগুনা রিজার্ভ নেওয়া ভালো। সে ক্ষেত্রে ভাড়া পড়বে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। ভোলাগঞ্জ থেকে নৌকা ভাড়া করতে হয়। সময়ভেদে ভাড়া ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকায় দয়ারবাজ। সেখান থেকে অটোরিকশায় চড়ারবাজার ভাড়া নেবে জনপ্রতি ৫০ টাকা।  

নৌপথে আগ্রহী হলে সিলেট শহরের সালুটিকর ও উমাইরগাঁও যেতে হবে। সেখান থেকে সরাসরি ভোলাগঞ্জের নৌকা ভাড়া করা যায়। ভাড়া পড়বে ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা।

যেতে হয় নৌপথে

সতর্কতা

অতিবৃষ্টির সময় উৎমাছড়ায় যাওয়া বিপজ্জনক। এ সময় পাহাড়ি ঢলের আশঙ্কা থাকে; থাকে পাহাড়ধসের আশঙ্কাও। তাই শরৎ ও হেমন্তকাল উৎমাছড়া ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সময়। পর্যটনস্থানটি ভারত সীমান্তবর্তী। সীমান্তের কাছাকাছি না যাওয়াই ভালো। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) আছে বিশেষ নজর। সীমান্তের শূন্যরেখার কাছাকাছি গেলেই বিজিবি সদস্যরা সতর্ক করে দেন নিয়মিত। সহযোগিতা করেন ভ্রমণপিপাসুদের। তাই ঘুরে বেড়ানোর সময় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড  সদস্যদের নির্দেশনা মেনে চলুন।