আম থাকুক যতনে


আম শুধু একটি ফলই নয়, এর সঙ্গে মিশে আছে হাজার রকম আবেগ। গ্রীষ্মের ছুটির আরেক নাম ছিল আম খাওয়ার ছুটি। একসময় বছরে শুধু দুবার মেয়েদের বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার চল ছিল। এই দুবারের একবারয় ছিল জ্যৈষ্ঠ মাসে। আমের প্রতি ভালোবাসা থেকেই একে সংরক্ষণের কথা মাথায় আসে। প্রিয় আমের স্বাদে মুগ্ধ বাঙালির অল্পতে সাধ মেটে না।

তখনকার গল্প বলছি, যখন ঘরে ঘরে ফ্রিজ ছিল না। বাজারে ছিল না কোল্ড স্টোরেজ। আমের ফলন দেখেই গৃহস্থ তাই ভাবতে বসে যেত এর সংরক্ষণ নিয়ে। শুরু হতো কাঁচা সবুজ আমে, আর শেষ ম-ম গন্ধে দারুণ পাকা আমের রসে। কাঁচা আমে তৈরি হতো আমচুর। আম কেটে নিয়ে লবণ-মরিচে মাখিয়ে শুকিয়ে নেওয়া হতো বৈশাখের রুদ্র তাপে। আমচুরের স্বাদের কথা যাঁদের মনে আছে, তাঁদের জিবে জল আসার আর বাকি নেই। টক টক স্বাদে বউ-ঝিয়ের মন মজিয়েছে বছর বছর।

কাঁচা আম সংরক্ষণ করা যায় আরও একভাবে। সে পদ্ধতির নাম আমসি। কাঁচা আম সেদ্ধ করে তার সঙ্গে লবণ-জিরা-হলুদ-মরিচ-পাঁচফোড়ন-লবণ আর ধনেগুঁড়া মিশিয়ে নিয়ে আঠালো মিশ্রণ তৈরি করে রোদে দিতে হবে। বারান্দা কিংবা ছাদের রোদ্দুরে শুকিয়ে তবেই তৈরি হবে আমসি। আমসির স্বাদ মনোহরা।

কাঁচা আমের পুরোনো সংরক্ষণপদ্ধতির মধ্যে ফলসি আর একটি। হলুদ-লবণ মাখিয়ে রোদে শুকিয়ে তারপর শর্ষে তেলে ডুবিয়ে তৈরি করা হতো ফলসি। বছরজুড়ে ভাতের পাতে, মুড়ি মাখাতে স্বাদ বাড়াত এই ফলসি।

আমের আচার

আম সংরক্ষণের সবচেয়ে বেশি পদ আছে আচারে। রসনাবিলাসীদের ঘরের তাকে নানা রকম আচার থাকবেই। খিচুড়ি, ভাত, মুড়ি, ভর্তা, যা-ই হোক না কেন, স্বাদ বাড়াতে আচারের জুড়ি নেই। তাই তো এ যুগের রন্ধনশিল্পীরা আবিষ্কার করে চলেছেন নতুন নতুন সব আচার।

আমের কাশ্মীরি আচার

মুখরোচক এসব আচারের কদর চিরকালের। মাটির চুলোয় রসুন-শর্ষেয় কাঁচা আম থেকে শুরু করে হালের ব্র্যান্ডেড আচার—আচারপ্রিয়দের দল ভারী হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমের টক আচার, মিষ্টি আচার, টক-মিষ্টি আচার, এর বাইরে ভিনদেশি একটি রেসিপি আমাদের দেশে দারুণ জনপ্রিয়। এর নাম আমের কাশ্মীরি আচার। কাঁচা আমে তৈরি করা হলেও এই আচারের স্বাদ মিষ্টি। তৈরির প্রথম ধাপেই আমের টক স্বাদ দূর করে নেওয়া এই আচার তৈরির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

কাঁচা আম সংরক্ষণ তো হলো। পাকা আমের মধুর রসে মুখ রঙিন করে ভাবতে বসতে হয় আম আর মাস খানেকেই বিদায় নেবে। তাই এবার সংরক্ষণের তাগিদ। সঠিকভাবে যত্ন করলে তবেই বছরের আরও কিছুদিন স্বাদ পাওয়া যাবে প্রিয় আমের।

আমসত্ত্ব

আমসত্ত্ব, পাকা আমে তৈরি এ খাবারে মুগ্ধ এ দেশের মানুষ। মিষ্টি আম জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় আমসত্ত্ব। এরপর রোদে শুকিয়ে হয় সম্পূর্ণতা। নারকেল দুধে ভিজিয়ে রেখে ভাতের পাতে আমতত্ত্ব অনেকেরই প্রিয়। শুকনো আমসত্ত্বও লা-জবাব।
পাকা আম সংরক্ষণে আমের জ্যাম-জেলিও কম যায় না।

ম্যাংগো জেলি

বিশেষ করে বাচ্চাদের কাছে আমের জেলি এক আকর্ষণের নাম। এক স্লাইস পাউরুটিতে ঘরে বানানো আমের জেলির প্রলেপের আকর্ষণ এড়ানো দায়। আবার আমের সঙ্গে মাখন মিশিয়ে ম্যাংগো বাটার তৈরি করা যায়, যা পাউরুটির সঙ্গে অসাধারণ লাগে। পাকা আমের স্কোয়াশের আবেদন ভোলা যায় না। একরাশ ভালো লাগা যেন একটি গ্লাসে।

বর্তমান সময়ে বাণিজ্যিকভাবেও আম সংরক্ষণর বিভিন্ন নতুন মাধ্যম দেখতে পাচ্ছি আমরা। বছরজুড়ে ক্রেতাকে আমের স্বাদ দেওয়াই এর উদ্দেশ্য। আমের জুস এ তালিকায় বহু পুরোনো নাম। নানা নামে আমরা আমের রসের বাজারজাতকরণ দেখি। কাচের বোতল ছেড়ে ট্রেট্রা প্যাকে এখন বাজার সয়লাব। সব বয়সের ক্রেতার কাছেই জনপ্রিয়তা এই প্রোডাক্টের।

ম্যাংগো স্কোয়াশ

ম্যাংগো বার এই তালিকার আর একটি নাম। এর জনপ্রিয়তাও বেশ। টক-মিষ্টি স্বাদের এই প্যাকেটজাত খাবারের নিয়মিত ক্রেতা রয়েছে। কারও কারও প্রিয় খাবারের তালিকাতে ম্যাংগো বারের নাম থাকলেও অবাক হওয়ার জো নেই। আমসত্ত্বের আধুনিক সংস্করণ এটি। ক্রেতা স্বাদে হারায় পুরোনো স্মৃতিতে। নস্টালজিক করে। ফেলে আসা শৈশব মনে করায়।

আমের স্বাদের লজেন্সও রয়েছে বাজারে। রয়েছে ম্যাংগো ফ্লেভারের ক্রিম বিস্কুট। মোটামুটি সব পরিচিত আইসক্রিম ব্র্যান্ডের রয়েছে আম ফ্লেভারের প্রোডাক্ট। প্রিয় ফলের স্বাদ নানাভাবে উপভোগ করতে চায় মানুষ। প্রিয়কে কেই-বা দূরে যেতে দিতে যায়। আম তো প্রিয়র তালিকারই। তাই নানা ছলে আমকে সংরক্ষণ করা যেন প্রিয়কেই কাছে রাখা।

ছবি: ইনস্টাগ্রাম