কাঁঠাল জাতীয় ফল হলেও জনপ্রিয়তায় আম সবার ওপরে। উৎপাদন ও বাণিজ্যের বিচারে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল এটি। আমের মৌসুম পাঁচ মাস। এর মধ্যে জুন ও জুলাই মাস আমের বাজার থাকে রমরমা। ১৫ মে থেকে উন্নত জাতের আমের মৌসুম শুরু হয়। চলে সেই প্রায় আগস্ট মাস পর্যন্ত। পুরোটা সময় বাজারে বাহারি আমের দেখা মেলে। দেশের অন্যান্য ফলের সঙ্গে আমের তুলনা হয় না। এর প্রধান কারণ, আম এমন একটি ফল, যা অতিমাত্রায় শৃঙ্খলা মেনে চলে। প্রতিটি জাতের আম প্রায় নিজ নিজ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পরিপক্ব হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত উন্নত জাতের আমের মধ্যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাজারে আসে প্রায় ২৫ জাতের আম। এর মধ্যে অতি উন্নত জাতের আম রয়েছে মাত্র ১০টি। তবে অন্তত ১৫ থেকে ২০ জাতের বাণিজ্যসফল আম দেশের বিভিন্ন বাজারে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বাণিজ্যসফল আমের জাত রয়েছে মাত্র ১০টি। মুশকিলের বিষয় হলো বাংলাদেশের মানুষ আমভক্ত ও ভোক্তা হিসেবে বিশ্বে প্রায় শীর্ষ স্থানে থাকলেও সঠিক জাতের আম এখনো বেশির ভাগ ক্রেতা চিনতে ভুল করেন।
বেশির ভাগ মানুষ ভালোভাবে চিনতে পারেন মাত্র দুই থেকে তিন জাতের আম। এগুলো হলো ফজলি, ল্যাংড়া ও আশ্বিনা। এর মধ্যে অনেকেই ফজলি ও আশ্বিনাকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন। আম–সংস্কৃতির এই হচ্ছে বাংলাদেশের হাল অবস্থা। সত্যের যুগ তো নেই, এখন চলছে ছলচাতুরী ও প্রতারণার যুগ। তাই ফলের বাজারে রাসায়নিকের প্রভাবে চলছে একধরনের নীরব মৃত্যুর হিমেল হাতছানি। এর বড় কারণ, সাধারণ মানুষ নানা রঙের দারুণ স্বাদ ও গন্ধের আম পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কেনার নেশায় ভুল করে বসেন। তাঁরা জানেন না প্রাকৃতিকভাবে কোন আম কখন পাকে এবং পরিপক্ব আম খাওয়ার সঠিক সময় কোনটি।
আমাদের দেশে উৎপাদিত ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পচনশীল হচ্ছে আম। এরপরই রয়েছে কলা। স্বাভাবিক কারণে ব্যবসায়ীরা এই দুটি ফল বেশি দিন ধরে রাখায় মনোযোগী না হয়ে বরং আগাম পাকানোর দিকেই বেশি আগ্রহী। শীতের দেশের ফল অনেক দিন পর্যন্ত নিজস্ব গুণাগুণ নিয়ে অটুট থাকে। রাসায়নিক দিয়ে সংরক্ষণ করলে আপেল, আঙুরের মতো ফল রাখা যায় দীর্ঘদিন।
প্রাকৃতিকভাবে পরিপক্ব আমে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক মিশিয়ে আপেল কিংবা আঙুরের মতো বেশি দিন রাখা মোটেই সম্ভব নয়। তবে এ কথা ঠিক যে আমে বিভিন্ন রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। রাসায়নিক মেশালেও পরিপক্ব আমের স্থায়িত্ব পাঁচ থেকে ছয় দিন মাত্র। এরপরই পচনক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।
কাজেই বাস্তবতা হচ্ছে, অসাধু আম ব্যবসায়ীরা গাছ থেকে অপরিপক্ব আম নামিয়ে কারবাইড বা ওই জাতীয় রাসায়নিক প্রয়োগের দিকে বেশি মনোযোগী হয়েছেন অধিক মুনাফার আশায়। এতে আম পেকে সুন্দর রং ধারণ করছে। বিক্রির উদ্দেশ্যে এই আম অন্তত ৮ থেকে ১০ দিন সংরক্ষণ করা যাচ্ছে। আমের ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীরা এই দ্বিতীয় পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। মৌসুমের প্রথমেই আম ব্যবসায়ীরা অতিমাত্রায় উৎসাহী আম–ভোক্তার হাতে কৌশলে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে পাকা আমের নামে অপুষ্ট আম তুলে দিচ্ছেন। এই আম খেতে মোটেও সুস্বাদু নয়। অপরিপক্বতার কারণে সে আম রসাল হয় না, সুগন্ধের ক্ষেত্রেও পূর্ণতা পায় না। প্রতারণার এই দ্বিতীয় ফাঁদ থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ রয়ে গেছে শতভাগ, যদি গ্রাহক একটু সচেতন হন। এ ক্ষেত্রে প্রথম কাজটি হবে সঠিক আমটির সঙ্গে পরিচিত হওয়া। এই কাজ খুব সহজ।
প্রাকৃতিকভাবে পাকা, ভেজালমুক্ত আম খাওয়ার জন্য মাত্র ৮ থেকে ১০ জাতের আম সঠিকভাবে চিনতে হবে, যেগুলো আমরা বেশি বেশি করে কিনি এবং খেয়ে থাকি। এই জাতের আমগুলো হচ্ছে গোপালভোগ, ক্ষীরসাপাতি, হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি, আশ্বিনা, আম্রপালি, লক্ষ্মণভোগ, রানিপছন্দ, হাঁড়িভাঙা, বারি-৪, বোম্বাই ইত্যাদি। ভেজালমুক্ত থাকার জন্য এই আমগুলো মৌসুমের কোন মাসে, ঠিক কোন সময়ের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে পাকে, তা জানাতে হবে। এই তথ্যগুলো জানলে ক্রেতারা সঠিক সময়ে ভেজালহীন আম কিনতে পারবেন। সব জাতের আম একই সময়ে পরিপক্ব হয় না। কিছু কিছু জাতের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ দিন সময় কমবেশি হয়ে থাকে। যেমন বান্দরবান এলাকায় উৎপাদিত আম্রপালি আম দেশের অন্যান্য অঞ্চলে উৎপাদিত আম্রপালি আমের চেয়ে অন্তত ১৫ দিন আগে পরিপক্ব হয়ে বাজারে আসে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় উৎপাদিত বারি-৪ রাজশাহী অঞ্চলে উৎপাদিত বারি-৪ আমের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ দিন আগে পুষ্ট হয়। আপাতত অন্য কোনো জাতের আমের ক্ষেত্রে আগাম প্রাকৃতিকভাবে পাকার ঘটনা নজরে আসেনি। অতএব এ কথা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আমরা যে আমগুলো হরহামেশা বাজার থেকে কিনি, সেগুলো শৃঙ্খলা মেনে বছরের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পেকে থাকে। এখন ভোক্তাকে শুধু জেনে নিতে হবে তার পছন্দের আমটি মৌসুমের ঠিক কোন সময়ে পাকছে। প্রয়োজনীয় এই তথ্যগুলো জানার পর আম কিনতে মনস্থির করুন।
অনেক কথা হলো। এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক বাংলাদেশের বাণিজ্যসফল প্রধান আমগুলো কেনার সঠিক সময়। সচেতন ভোক্তারা সঠিক সময়ে তাঁদের পছন্দের আমটি কিনতে পারলে রাসায়নিক মেশানো আমের প্রভাব থেকে নিজেকে ও পরিবারের সদস্যদের মুক্ত রাখতে সক্ষম হবেন।
আমের নাম | কেনার সঠিক সময় | যে জেলায় জন্মে |
---|---|---|
গোবিন্দভোগ | ১৫ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত | সাতক্ষীরা |
গোপালভোগ | ২৫ মে থেকে ১০ জুন পর্যন্ত | চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, দিনাজপুর ও সাতক্ষীরা |
রানিপছন্দ | ১ থেকে ১৫ জুনের মধ্যে | চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী |
ক্ষীরসাপাতি | ৭ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত | চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, দিনাজপুর ও সাতক্ষীরা |
নাক ফজলি | ৮ থেকে ২৫ জুন | চাঁপাইনবাবগঞ্জ |
বোগলাগুটি | ১২ জুন থেকে ৭ জুলাই | চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর |
বারি আম-২ (লক্ষ্মণভোগ) | ১৫ জুন থেকে ১৫ জুলাই | চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর |
বোম্বাই | ১২ জুন থেকে ৫ জুলাই | মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ |
ল্যাংড়া | ১৫ জুন থেকে ১৫ জুলাই | চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও সাতক্ষীরা |
তোতাপুরি | ১৫ জুন থেকে ১০ জুলাই | চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর |
হাঁড়িভাঙা | ২০ জুন থেকে ৫ আগস্ট | রংপুরের মিঠাপুকুর ও বদরগঞ্জ উপজেলা |
আম্রপালি | ২৮ জুন থেকে ২৫ জুলাই | সমগ্র বাংলাদেশ |
সূর্যপুরী | ১ জুলাই থেকে ২০ জুলাই | বালিয়াডাঙ্গী, ঠাকুরগাঁও |
সুরমা ফজলি | ৩০ জুন থেকে ৩০ জুলাই | চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর |
ফজলি | ৫ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট | চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, দিনাজপুর ও সাতক্ষীরা |
বারি-৪ ৭ | জুলাই থেকে ২০ জুলাই : (রাজশাহী অঞ্চলে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ) | চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী |
মল্লিকা ৭ | জুলাই থেকে ৫ আগস্ট | রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ |
মোহনভোগ | ৮ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই | চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর |
আশ্বিনা | ২০ জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর | চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ |
গৌরমতি | ২০ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর | চাঁপাইনবাবগঞ্জ |
চৌষা | ১০ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট | চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী |
লেখক: নদী ও স্থানীয় ইতিহাসবিষয়ক গবেষক।