মাহবুবুর রহমান। চোখের আলো নেই, তবে মনের আলো আর মনের জোরে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৩৪তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হওয়ার গল্পটাও অনন্য। মাহবুবুর রহমান বর্তমানে সিলেট টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক। তাঁর মতো দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এগিয়ে নিতে গড়ে তুলেছেন সাংস্কৃতিক সংগঠন গঙ্গাপদ্মা শিল্পীগোষ্ঠী। সাক্ষাৎকারের উঠে এসেছে মাহবুবুর রহমানের জীবনের কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সজীব মিয়া
গঙ্গাপদ্মা শিল্পীগোষ্ঠী কী ধরনের কাজ করে?
মাহবুবুর রহমান: গঙ্গাপদ্মা শিল্পীগোষ্ঠী শ্রুতিনাটক তৈরি করছে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য এটি একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে গড়া তোলার কাজ করছি আমরা। এই মানুষদের কর্মক্ষেত্র সীমিত। আমরা তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সমাজের মূল ধারায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। তাই রেডিও ও টিভিগুলো যেন আমাদের নাটক নেয়, তারই চেষ্টা করছি।
নাটকগুলো আপনারা কীভাবে নির্মাণ করেন?
মাহবুবুর রহমান: নাটক নির্মাণের পথটাও আমাদের জন্য মসৃণ নয়। লিখিত কোনো চিত্রনাট্য সরাসরি আমাদের কাজে আসে না। আমাদের কর্মীরাও একেকজন দেশের একেক প্রান্তে থাকেন। তাই হোয়াটসঅ্যাপে তাঁদের নির্দেশনা দিতে হয়। তাঁরাও তাঁদের অভিনীত অংশ রেকর্ড করে পাঠায় সম্পাদনার জন্য। এরপর আমি মূল নাটকটি দাঁড় করাই। আমরা বেশ কিছু নাটক তৈরি করেছি। একটি নাটক এবিসি রেডিও ৮৯.২ এফএমে প্রচারিত হয়েছে।
আপনার পেশাগত জীবন কেমন চলছে?
মাহবুবুর রহমান: আমি ইংরেজি বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে সিলেট টিচার্স ট্রেনিং কলেজে কাজ করছি। মাঝে শিক্ষাছুটিতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। সেখানকার বোস্টন কলেজে পাঠক্রম শিক্ষাদান বিষয়ে এমএড সম্পন্ন করেছি।
এটি আপনার প্রথম কর্মক্ষেত্র?
মাহবুবুর রহমান: আমার প্রথম চাকরি ছিল স্নাতকোত্তর শেষ করার পর। তখন সহযোগী শিক্ষক হিসেবে সরকারি প্রকল্পের অধীনে সিলেটের গোয়াইনঘাটের একটি স্কুলে যোগ দিয়েছিলাম। এরপর তো বিসিএস হলো।
বিসিএস দিতে গিয়ে কেমন অভিজ্ঞতা হলো?
মাহবুবুর রহমান: স্নাতকের শেষ দিকেই নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। বিসিএসের প্রস্তুতিও চলছিল। আমি ৩৪তম বিসিএসে অংশ নিয়েছিলাম। অনেক আন্দোলনের পর ৩২তম বিসিএস থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন, কিন্তু কেউ চূড়ান্ত নিয়োগ পাননি। ৩৪ম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় আমরা ২০ থেকে ২৫ জন অংশ নিয়েছিলাম। শ্রুতলেখকের সহায়তায় পরীক্ষা দিলাম। লিখিত পরীক্ষা শেষে আমরা চারজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সাক্ষাৎকারের জন্য ডাক পেয়েছিলাম। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি হিসেবে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে আমিই প্রথম নিয়োগ পেলাম।
এর মধ্যেই তো নরওয়ে থেকে ডাক এল...
মাহবুবুর রহমান: যে দিন ৩৪তম বিসিএসের সাক্ষাৎকার দিয়ে আসি, সেদিন রাতেই নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব অসলো থেকে একটি মেইল পাই। তারা জানায়, আমি এমফিল করার সুযোগ পেয়েছি। একধরনের দোটানায় পড়ে যাই। বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের সময় যেহেতু তখনো ঠিক হয়নি, তাই আমার শিক্ষকেরা তখন পরামর্শ দিলেন নরওয়ে যাওয়ার।
সেখানে অভিজ্ঞতা কেমন হলো?
মাহবুবুর রহমান: দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হিসেবে শুরুতে এ–যাত্রায় বিশাল প্রতিবন্ধকতা ছিল। ভিনদেশ, নতুন পরিবেশ, বরফের ওপর হাঁটা, একা রান্না করে খাওয়া—নবজাতকের মতো আমাকে নতুন করে শিখতে হলো সব। ছোটবেলা থেকে চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি, চ্যালেঞ্জ নিয়েই তো এটুকু পথ এলাম। এরপর নরওয়ের দিনগুলো সুন্দর কাটল। এমফিলের বিষয় ছিল বিশেষ শিক্ষা।
বিসিএসে চূড়ান্ত নিয়োগ পেলেন কবে?
মাহবুবুর রহমান: এর মধ্যে দেশে আসতে হয়েছিল। বিসিএসের জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিতে হয়েছে। যোগদানের প্রক্রিয়া যখন শুরু হলো, তখন আমি দেশেই। ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতেই হয়। কারণ, এমফিলের অংশ হিসেবে তখন আমি দেশে উপাত্ত সংগ্রহের কাজ করছিলাম। ২০১৬ সালে সিলেটের চুনারুঘাট সরকারি কলেজে যোগ দিই। ইউনিভার্সিটি অব অসলোর তখনো একটি সেমিস্টার অসম্পন্ন ছিল। চুনারুঘাটের কর্মস্থলে ছয় মাস কাটানোর পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করি সেমিস্টার সম্পন্ন করার জন্য। ছুটি পাই। এরপর এসে যোগ দিই সিলেট টিচার ট্রেনিং কলেজে।
আপনি নিজেও তো সিলেটে পড়াশোনা করেছেন?
মাহবুবুর রহমান: আমাদের বাড়ি সিলেটে। শৈশবে স্থানীয় এক হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হয়েছিল। এরপর আবাসিক শিক্ষার্থী হিসেবে আমার স্কুলজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৯৫ সালে, ঢাকার মিরপুর ১৪ নম্বরের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে। ২০০০ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন সিলেটে সমন্বিত অন্ধ শিক্ষা প্রকল্পের অধীনে স্কুল ছিল না। মৌলভীবাজারের বিদ্যালয়ে ছিল। একজন শিক্ষক ছিলেন আমাদের দেখভাল করার জন্য। এ কারণেই সেখানে ভর্তি হওয়া। ২০০৫ সালে আমি এসএসসি পাস করি সেই স্কুল থেকে। মানবিক বিভাগ থেকে আমার ফল ছিল জিপিএ–৪.৮৮।
উচ্চমাধ্যমিক কোথায় পড়লেন?
মাহবুবুর রহমান: উচ্চমাধ্যমিক ভর্তি হই সিলেট জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। আমাদের বাসার কাছেই। ২০০৭ সালে জিপিএ–৪.৪০ পেয়ে আমি উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করি। আমরা কোচিং সেন্টারে কোচিং করতে পারতাম না। আমি বিভিন্ন কোচিং থেকে লেকচার শিট জোগাড় করতাম। সেগুলো আমার বোনেরা রেকর্ড করে দিত। আমি শুনে শুনে পড়তাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম একজন শ্রুতলেখকের সহায়তায়। ভর্তি পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হই। ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তির সুযোগ পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই আমি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি।
পরিবারে আর কে আছেন?
মাহবুবুর রহমান: আমার মা-বাবা আর ছোট তিন বোন। তাঁদের কারণেই আমি আজ এতটা পথ আসতে পেরেছি।
শৈশবেই কি চোখের আলো হারিয়ে ফেলেন?
মাহবুবুর রহমান: আমার জন্মের কিছুদিনের মধ্যে মা-বাবা বুঝে ফেলেন, আমার চোখে সমস্যা আছে। তখন আমার মা-বাবা তো তরুণ। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা এমন একজন শিশুকে নিয়ে কিছুটা কষ্ট পেলেন। কিন্তু ভেঙে পড়লেন না। শৈশবে নিজেকে যখন বুঝতে পারতাম না, তত দিন পর্যন্ত সমস্যা ছিল না। যখন আমি বাইরে গেলাম, যখন আমি খেলতে গেলাম তখন বুঝলাম আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা। যারা ক্রিকেট বা ব্যাডমিন্টন খেলছে, আমি তো তাদের সঙ্গে খেলতে পারছি না। আমার বেশির ভাগ সময় কাটত বড় ভাইদের সঙ্গে গল্পগুজব করে। আমি তখন সৃজনশীল কিছু করতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার আম্মু খুব বুদ্ধিমতী। তিনি আমাকে আবৃত্তির ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিলেন, গানের ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার বিকেল যেন ভালো করে কাটে। কিন্তু তারপরও একটা পার্থক্য তৈরি হলো।
সে পার্থক্য ঘোচাতেই কি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কাজ করছেন?
মাহবুবুর রহমান: অনেকটা সে কারণেই। তাঁদের নিয়ে আমি বেশ কিছু গবেষণার কাজ হাতে নিয়েছি। তাঁদের কর্মসংস্থানের পথ খুঁজছি। অনুসন্ধান করছি। ভয়েস ওভার, ভয়েস অ্যাকটিংসহ এমন কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অনায়াসে ভালো করতে পারেন। আমি আমার মেধা-শ্রম দিয়ে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছি, তাঁদের এগিয়ে নিতে তা প্রয়োগ করব, তাঁদের মূল ধারায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করব।