ছোট্ট আয়মান ক্যানসারে মারা গেছে। মায়ের পক্ষে এ মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। তবে মা ভাবলেন, নিজের ছেলেকে ধরে রাখতে না পারার যে কষ্ট বা চোখের সামনে ছেলেকে কষ্ট পেতে দেখার যে কষ্ট, তা ভুক্তভোগী অন্য পরিবারগুলোর সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিলে দুই পক্ষেরই কষ্টের বোঝা কিছুটা কমবে। আর ছেলেকে নিয়ে দেশ-বিদেশের হাসপাতালে ঘুরে অভিজ্ঞতাও প্রচুর হয়েছে। এই তথ্যগুলো জানালেও ক্যানসার রোগী আছে, এমন পরিবারে অনেক কাজে দেবে।
এই মা হলেন সায়মা সাফীজ সুমি। গত বছর ক্যানসার নিয়ে ওরা নেই ওরা আছে নামের একটি বই লিখেছেন। প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সায়মা সকাল শুরু করেন প্রশান্তির কথা বলে। যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে কীভাবে ভালো রাখা যাবে, সে আশাবাদের কথা জানান। গত ২০ এপ্রিল এই মায়ের সকাল শুরুর কথাগুলো হলো—‘শুভ দিন। এত কিছুর পরও দিনটি প্রশান্তিময় কাটুক। ভবিষ্যৎ একেবারেই অনিশ্চিত। তা ছাড়া অতীতেও ফিরে যাওয়া যাবে না। তাই সবাই বর্তমানে থাকি।’
সায়মা সাফীজ প্রশান্তি নামের একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে বাবার বাড়ির গ্যারেজে চলে এ সংগঠনের কাজ। বিশ্বের ১৫৬টি দেশে পরিচালিত ভারতের বেসরকারি সংগঠন আর্ট অব লিভিংয়ের বাংলাদেশ কেন্দ্রে তিনি একজন মেডিটেশন বা ধ্যানের প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। আর ক্যানসার রোগী ও পরিবারের সদস্যদের জন্য কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে। দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্যানসার, খাদ্যাভ্যাসসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরাসরি কথা বলেছেন করোনার প্রাদুর্ভাবের আগে। সব থেকে বড় কথা, গায়ের রং নিয়ে কিংবা সৃষ্টিকর্তা ছেলে বানাতে গিয়ে মেয়ে বানিয়েছেন—এ ধরনের মন্তব্যে যিনি আয়না দেখতে ভয় পেতেন, সেই তিনিই জীবনের ৪৫ বছর বয়সে এসে উপলব্ধি করেছেন তাঁর হাসি সুন্দর। এখন তিনি আয়না দেখেন, মাথায় ফুল লাগিয়ে মন চাইলে বড় টিপ দিয়ে হাসিমুখের ছবি ফেসবুকে দেন।
সায়মার ছেলে আয়মানের জন্ম ২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল। গত ১৯ এপ্রিল ছেলের জন্মদিনেই এই মায়ের সঙ্গে কথা হয় টেলিফোনে। ক্যানসারে ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি আয়মান মারা যায়। এরপরই পাল্টে যায় সায়মার জীবন। ২০১০ সালে জন্ম দেওয়ার পর মাত্র ৯ দিন পর সায়মা আরেক ছেলেকে হারান। এই দুই ছেলের জন্মের আগে প্রথম সন্তান জন্ম দিতেও অনেক জটিলতা পোহাতে হয়। সেই প্রথম সন্তান মেয়ে এখন ১৬ বছরের কিশোরী।
সায়মা বলেন, ‘কোনো পরিবারে, বিশেষ করে সন্তানের ক্যানসার হলে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যেও একধরনের দূরত্ব তৈরি হতে পারে। কেননা, তখন আসলে তাঁরা নিজেদের সেভাবে সময় দিতে পারেন না। ছেলে মারা যাওয়ার পর আমি সামাজিক নানা কাজে যুক্ত হয়ে যাই। আস্তে আস্তে আমার স্বামীর সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হয়। গত বছর দুজনের সম্মতিতেই আমরা আলাদা হয়ে গেছি। মেয়ে নিজের সিদ্ধান্তে থাকছে তার বাবার সঙ্গে। তবে আয়মানের মৃত্যুর বা মেয়ের যেকোনো বিষয়ে ওদের বাবা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমি আমার বৃদ্ধ মা-বাবার বাসায় একটি ফ্ল্যাটে বিনা মূল্যে থাকার সুযোগ পেয়েছি। আর অন্যান্য কাজ করে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে দিন ভালোই কাটছে।’
ছেলেকে নিয়ে আট মাস থাইল্যান্ড ও ভারতের হাসপাতালে থাকতে হয়েছে সায়মার। চোখের সামনে তখন অনেক মৃত্যু দেখছেন। তারপর তো নিজের ছেলের মৃত্যু। সায়মা বলেন, ‘ছেলে মারা যাওয়ার পর ওর ছোট শরীরটা ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষকে স্বস্তি দেয়, সে ধরনের কাজ করব। আর ছোট বেলা থেকেই মাদার তেরেসার কাজের প্রতি অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করত।’
সায়মা দীর্ঘ ১১ বছর একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। সেই কর্মস্থলেই তিনি ধ্যান সম্পর্কে জানতে পারেন। বর্তমানে তিনি ধ্যান, যোগব্যায়াম, কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ক্যানসার রোগী, রোগীর পরিবারসহ যেকোনো সমস্যায় থাকা মানুষের মনে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। করোনাভাইরাসের প্রকোপের কারণে কাজগুলো এখন তিনি অনলাইনে করছেন। অন্য সময় প্রশান্তির কার্যালয়ে এ কাজগুলো করেন।
ছেলে মারা যাওয়ার পর সায়মা আশিক ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ ফাউন্ডেশন ক্যানসারে আক্রান্ত শিশু ও শিশুর পরিবারকে নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছে। বিশেষ করে যে শিশুর চিকিৎসায় আর ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, ওই শিশুর মৃত্যুটা যাতে একটু আরামদায়ক করা যায় (প্যালিয়েটিভ কেয়ার), তা নিয়ে কাজ করছে।
সায়মা পড়াশোনা করেছেন পদার্থবিজ্ঞানে। তাই নতুন বিষয়ে কাজ করার আগে প্যালিয়েটিভ কেয়ার, কাউন্সেলিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে দেশ-বিদেশের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন কোর্স করেছেন, যাতে কাজ করতে গেলে তাঁকে নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারেন।
সায়মার বয়স যখন মাত্র চার বছর, তখন তাঁর বাবা সাফিজ উদ্দিন আহমেদ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। মা খোরশেদা বেগম স্বামী ও দুই মেয়ের সংসারের হাল ধরেন, এখনো ধরে আছেন। সায়মা বলেন, ‘বাবার অসুস্থতার জন্যই হয়তো আমার সাহস বরাবরই বেশি ছিল। আমি ছিলাম “টম বয়”মার্কা। পোশাক-চাল চলন সবই ছিল ছেলেদের মতো। বাজার করা থেকে শুরু করে বাইরের কাজগুলো আমিই করতাম। তা নিয়ে মানুষ অনেক কথাও শোনাত। তবে থেমে যাইনি বা থামার কোনো উপায় ছিল না।’
নিজের ছেলের চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিজেই ঋণগ্রস্ত সায়মা। তাই কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত হলে বলেছেন খবর দিতে। সায়মা বলেন, ‘টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারি না, তবে জড়িয়ে ধরে সাহস জোগাতে পারি। এমনও হয়েছে, অনেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকেন, এই কান্নাটাই তাঁর জন্য জরুরি ছিল। তারপর দরকার হয় নানান ধরনের তথ্য। রক্ত কোথায় পাওয়া যাবে, দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য ভিসা কীভাবে করতে হবে—এসব নানান তথ্য জানিয়ে সহায়তা করতে পারি। এ কাজগুলোর জন্য পারিশ্রমিক নিই না।’ তবে যোগব্যায়াম, ধ্যান করানোর জন্য পারিশ্রমিক নেন তিনি।
সব মিলে এখন কেমন আছেন? সায়মার ভাষায়, ‘আমার বন্ধুরা বলে আমি নাকি সবার মা হয়ে গেছি। যেকোনো পরিস্থিতিতে ইতিবাচক চিন্তা করতে শিখেছি। বড় কথা, নিজেকে ভালোবাসতে শিখেছি, হাসতে শিখেছি।’