>আমিনুল ইসলাম ও তাসমিয়া হাবিবার বিয়ের কথা তখন প্রায় পাকাপাকি। সেই সময়ই ঘটল দুর্ঘটনাটি। প্রাণে বাঁচলেও ডান হাত হারালেন তাসমিয়া। ওদিকে দুর্ঘটনার পর আমিনুলের পরিবার পিছিয়ে গেল বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে। তবে অটল থাকলেন আমিনুল নিজে। অনেকটা পরিবারের সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করেই বিয়েও করলেন। বিয়ের এক বছর হচ্ছে আসছে ১১ ফেব্রুয়ারি। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসের আগে পড়ুন তাঁদের জীবনের ভালোবাসার সত্য গল্প।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের একটি রেস্তোরাঁয় বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতেই সন্ধ্যা নেমে এল। যাপিত জীবনের নানা গল্প চলছে তখন। জীবনের নানা আলাপের ফাঁকে যে গল্পটি আমরা বারবার জানতে চাইছিলাম, তার মধ্যে হঠাৎই ডুব দিলেন তাসমিয়া হাবিবা। পাশে বসা আমিনুল ইসলাম অনেকটা সময় ধরে সে গল্পে সায় দিয়ে গেলেন। যোগ করলেন নিজের কথা। এই দম্পতি বিয়ের গল্প যখন বলছিলেন, তখন মনে হলো সেটা যেন কোনো সিনেমা।
প্রথম দেখা ফেসবুকে
ছেলের বিয়ের জন্য হন্যে হয়ে পাত্রী খুঁজছিল আমিনুল ইসলামের পরিবার। পরিচিত একজন ঘটকের মাধ্যমে কিছু খোঁজখবরও নেওয়া হয়। এমন সময় চট্টগ্রাম নগরীর চট্টেশ্বরী মোড় এলাকায়, আমিনুলদের বাড়ির কাছেই এক মেয়ের খোঁজ পাওয়া গেল। মেয়েটি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।
সেই মেয়েই তাসমিয়া হাবিবা। আমিনুলের মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন তাঁদের বাসায়। দুই পরিবারের পক্ষ থেকে আলোচনা হলো। আমিনুল ইসলাম, যিনি কাছের মানুষদের কাছে মিঠু নামে পরিচিত, তিনি তখন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক। দুই পরিবারই প্রাথমিক আলোচনায় সম্মত হলো বিয়ের ব্যাপারে। সেদিন আলোচনার এক ফাঁকে ছেলের ফেসবুক ঠিকানা তাসমিয়ার মায়ের কাছে দিয়ে এসেছিলেন আমিনুলের মা। আর তাসমিয়ার প্রোফাইলের ঠিকানাও সঙ্গে নিয়েছিলেন।
আমিনুল ফেসবুকে খুঁজে নিলেন তাসমিয়াকে। প্রোফাইলের ছবিটি দেখে কী মনে হয়েছিল? পাশে বসা তাসমিয়ার দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে আমিনুল বলেন, ‘বাহ, মেয়েটা দেখতে ভারি মিষ্টি!’
আর আপনার? তাসমিয়ার কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা।
বাঁ হাতে কৃত্রিম ডান হাতটা ধরে তুলে রাখলেন টেবিলের ওপর। তারপর তাসমিয়া বলেন, ‘মায়ের সঙ্গে আমি বেশ খোলামেলা। মা তাঁর ফেসবুক প্রোফাইল দিলেন। আমিও দেখলাম ওয়াল ঘেঁটে। দেখে মনে হলো, ছেলেটা মন্দ নয়!’
দুজনের আলাপ শুরু হলো ফেসবুকে। দুজনই যেহেতু দুজনকে পছন্দ করেছেন, তাই দুই পরিবারই বিয়ের কথা চূড়ান্ত করতে চাইল। তবে তারও আগে সবাই চাইল, আমিনুল ও তাসমিয়া সামনাসামনি দেখা করুক, কথা বলুক।
দেখা করার দিনটি নিয়ে দুই পরিবারের কথা হয়েছিল। তাসমিয়া বলেন, ‘সাক্ষাতের সময়টা ঠিক করা হলো আমাদের একটি পারিবারিক ভ্রমণের পর।’ পরিবারের সঙ্গে সেই ভ্রমণটি ছিল খাগড়াছড়িতে।
সুন্দর স্বপ্নের পরিণতি দুঃস্বপ্নে
আনন্দভ্রমণ। পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়া মানেই তো তাই। খাগড়াছড়ি পৌঁছেই সাজেকে যাওয়ার চাঁদের গাড়িতে উঠেছিল তাসমিয়ারা। তাঁদের সঙ্গে গাড়িতে ছিল তরুণ পর্যটকদের আরেকটি দল। সবুজ পাহাড়ে বেশ রোমাঞ্চকর যাত্রা। পাহাড়ে যেতে যেতে কত কল্পনার রং ছড়াল তাসমিয়া। আগামী দিনের স্বপ্নও বুনল কতকটা। সাজেক থেকে ফিরেই দেখা হবে। প্রথম সাক্ষাতে কীভাবে কথা বলবে। কত কথাই তো এত দিন হলো, কিন্তু সামনাসামনি?
রোলার কোস্টারের মতো চাঁদের গাড়ি এগিয়ে যায়। খাড়া পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠে। আবার সাঁই করে নেমে যায়। তরুণ দল সোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে। তাতে শামিল হন তাসমিয়ারাও। এভাবেই একসময় পৌঁছান সাজেকের কাছাকাছি। প্রকৃতি দেখে মুগ্ধতা যখন বাড়তে থাকল, তখনই ঘটল দুর্ঘটনা। চাঁদের গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারাল চালক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পড়ে গেল খাদে।
কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু নিঃশব্দ। তারপর? তাসমিয়া বলেন, ‘এরপর আমি চোখ মেলে দেখি খাগড়াছড়ি জেনারেল হাসপাতালে।’ সেখানে চিকিৎসা শেষে পাঠানো হলো চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। চিকিৎসক জানিয়ে দিলেন, তাসমিয়ার ডান হাতটি কাটতেই হবে।
হাত হারানোর দিনগুলো
চট্টগ্রাম থেকে তাসমিয়াকে আনা হলো ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানেই অস্ত্রোপচার করে কাটা হলো তাসমিয়ার ডান হাত। সংজ্ঞা ফিরে এলে মুষড়ে পড়েন তাসমিয়া। ‘একটি হাত নেই, এটা আমি ভাবতেই পারছিলাম না। একটি অঙ্গ না থাকা কতটা কষ্টের, কতটা বেদনার, তা আমি তখন অনুভব করতে শুরু করলাম। কেমন যেন সবকিছু ফাঁকা লাগছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, কী যেন নেই আমার।’ পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন তাসমিয়া।
হাসপাতালে কাটল কয়েক মাস। একসময় বাড়ি ফিরে গেলেন। তাসমিয়া বলছিলেন, ‘আমি তখন ভয়ে আয়নার সামনে যেতাম না।’ কিন্তু এই ভয় একসময় জয় করলেন তাসমিয়া। সহপাঠী আর শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। ভাবলেন, তাঁকে পারতেই হবে। ক্লাস শুরু করলেন। এক হাতে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে শিখলেন। সেসব দিনের কথা বলেন তিনি, ‘২৫ বছর পর নতুন করে বাঁ হাতে লিখতে–শিখতে শুরু করলাম। তখন আমার শিক্ষকেরা এগিয়ে এসেছিলেন। আলাদাভাবে আমার পরীক্ষা নিতেন।’
সিদ্ধান্তে অটুট আমিনুল
দুর্ঘটনার খবর আমিনুল ইসলাম জানতে পারেন তিন দিন পর। তখন ঢাকায় তাসমিয়া। আমিনুল ফোন করেন তাসমিয়ার মাকে। আমিনুল বলেন, ‘তিনি তখন কাঁদছিলেন। হাত কেটে ফেলার খবরও জেনে যাই। আমি খবর পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে যাই।’ কিন্তু গিয়ে তাসমিয়ার সঙ্গে দেখা করার সাহস পেলেন না আমিনুল। ‘প্রথম দেখা এভাবে হবে, কী বলব, তাসমিয়া কী ভাববে—এসব সাতপাঁচ ভেবে চলে আসি’ বলেন আমিনুল।
দিন যায়, রাত যায়, মনের ভেতরটা ডুকরে ওঠে আমিনুল ইসলামের। সারাক্ষণ তাসমিয়ার কথা ভাবেন। আরও কয়েক মাস পর চট্টগ্রামে যাওয়ার পর জানতে পারলেন তাসমিয়ার কৃত্রিম হাত সংযোজন করা হবে। ওদিকে আমিনুলের পরিবার আবার পাত্রী দেখা শুরু করেছে। কিন্তু আমিনুল জানালেন, তাসমিয়াকেই বিয়ে করতে চান। অনেকে বোঝালেন, এক হাত যার নেই, তাকে কেন! সে সংসার সামলাবে কী করে, সন্তান লালন–পালনই বা করবে কী করে... ইত্যাদি আরও নানা কথা। আমিনুল খুব কষ্ট পেলেন। তাঁর মনে পড়ল রানা প্লাজা ধসের সময়কার একটি স্মৃতি। আমিনুল ইসলাম সে স্মৃতি শোনালেন আমাদের, ‘রানা প্লাজা ধসের পর আমি পেশাগত দায়িত্বে সেখানে ছিলাম। একজন নারী শ্রমিককে উদ্ধার করা হলো, হাত কাটা পড়েছে। স্ট্রেচারে নিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটা বিলাপ করতে করতে বলছিল, ‘হাত কাটা বউ কি শ্বশুরবাড়ির লোক মেনে নেবে...।’
আমিনুল তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিলেন পরিবারের কাছে।
এই বেশ ভালো আছি
তারপর নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে দুজনের বিয়ে হলো। দিনটি ২০১৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। বিয়ের আগের সেসব কষ্টের কথা দুজনই এড়িয়ে যেতে চাইলেন। এড়িয়ে যেতে চাওয়ার কারণ, পরিবারের মানুষদের কথা ভেবে। তাঁরা চান না, তাঁদের কথায় আপন মানুষেরা কষ্ট পাক। আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘দিনে দিনে সবই হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।
আমরা তো ভালো আছি। আমার কখনো মনে হয় না, ওর একটা হাত নেই। সে তো দিব্যি সব কাজ করতে পারে।’
তাসমিয়া তাকিয়ে ছিলেন আমিনুলের দিকে। তিনি কথায় তাল মেলান। যোগ করেন নিজেদের যৌথ স্বপ্নের কথা। যে স্বপ্নের পরতে পরতে মিশে থাকল আত্মবিশ্বাস, আস্থা আর অকৃত্রিম ভালোবাসা। যে ভালোবাসা তাঁদের দুজনকে এক করেছে।