>
আয়রনম্যান মালয়েশিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন তিন বাংলাদেশি প্রতিযোগী। সাঁতার, সাইক্লিং ও দৌড়—প্রতিযোগিতার এই তিন অংশ সম্পন্ন করে তিনজনই পেয়েছেন সনদ। তাঁদেরই একজন লিখেছেন অভিজ্ঞতার কথা।
ঝকঝকে আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল মুহূর্তেই। ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করল। ধাতস্থ হতে হতেই টুপটাপ বৃষ্টিও পড়তে থাকল। সমুদ্রের ঢেউয়ের রূপও গেল বদলে। সাঁতরাতে ভীষণ বেগ পেতে হচ্ছিল। তখনো ৭০০ মিটারের মতো সাঁতরানো বাকি। কিন্তু লক্ষ্য ঠিক রেখে এগোনো যাচ্ছিল না। এরই মধ্যে একজনের কনুই লেগে সাঁতারের চশমাটা গেল খুলে। কী ভয়াবহ! মালয়েশিয়ার ল্যাংকাওয়িতে আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জের প্রথম পর্বটা এভাবেই শেষ করেছি। সাঁতারের সময়ই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি কেন এটা বিশ্বের চ্যালেঞ্জিং প্রতিযোগিতার একটি।
সাঁতার শুরুর আগে
১৭ নভেম্বর। দিনের সূর্য উঁকি দিতে দিতেই সকাল সাতটা বেজে গেল। আমরা সৈকতে হাজির হয়েছিলাম তারও ঘণ্টাখানেক আগে। আমরা মানে আমি, আবদুল্লাহ আল ইমরান ও ইমতিয়াজ ইলাহি। আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জের জন্য বাংলাদেশ থেকে এই তিনজনই গিয়েছিলাম।
দেশ থেকে একসঙ্গে গেলেও প্রতিযোগিতায় তিনজন ছিলাম আলাদা আলাদা দলে। দলগুলো ভাগ করা হয়েছিল বয়সের ভিত্তিতে। আলাদা দলে ভিড়ে ভেতরের উত্তেজনা আরও বাড়ল। কী হবে, কেমন করে হবে, পারব তো শেষ পর্যন্ত! এসব ভাবতে ভাবতেই আটটা বাজল। আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জের তিনটি পর্ব—সাঁতার, সাইক্লিং (সাইকেল চালনা) আর দৌড়।
সমুদ্রে ত্রিভুজাকার জায়গা তৈরি করা হয়েছিল সাঁতার কাটার জন্য। দূরত্ব ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার। এ দূরত্ব পাড়ি দিতে হয় দুইবার। কারণ, প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী প্রতিযোগীদের সাঁতরাতে হয়েছে ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এই পর্বে নানা বয়সী ২ হাজার ৪০০ প্রতিযোগী অংশ নিয়েছিল।
পাহাড়, ঝড় আর সাইক্লিং
পরের চ্যালেঞ্জটি সাইক্লিং। সাইকেল চালিয়ে ১৮০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। সময় আট ঘণ্টা। সেই যে সকালে ঝড়বৃষ্টি শুরু হলো, তার রেশ তখনো। সাইকেল চালানো বেশ কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। একে তো পাহাড়ি পথ, তার ওপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বিপজ্জনক মোড়গুলোতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা। তাই খুব সতর্কতার সঙ্গে সাইকেল চালাচ্ছিলাম। একটু এদিক-সেদিক হলেই ঠাঁই হবে পাহাড়ের গোড়ায়! এমন সংকট সঙ্গী করে পুরো ট্র্যাকটি শেষ করলাম সাড়ে ছয় ঘণ্টায়।
বরফ বেঁধে দৌড়
ঝোড়ো ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতার আর বৃষ্টি ভেজা পাহাড়ি পথে সাইকেল চালিয়ে আমার পা ফুলে ঢোল। ১০ কিলোমিটার চলার পর ব্যথা নিয়ে দৌড়ানো অনেকটা অসম্ভবই। কিন্তু ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু...। এত দূর এসে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে চাই না। শুরু করলাম পথ চলা। অনেকটা হেঁটে হেঁটেই।
প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী, নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া থামা যাবে না। সেখানে থামলেও সুনির্দিষ্ট কারণ থাকতে হবে। এমন একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিলাম। চিকিৎসা দল পায়ে বরফ বেঁধে দিল। তারপর আবার দৌড়াতে শুরু করলাম। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দৌড়ানোর সময় রাস্তার পাশে দাঁড়ানো মানুষ সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছিল। আমাকেও বলল, ‘এগিয়ে যাও, তুমি পারবে।’ আমাকে দারুণ আত্মবিশ্বাসী করেছিল। এভাবেই একসময় পা রাখি ‘ফিনিশিং লাইনে’। ৪২ কিলোমিটারের দৌড়ে শেষ সীমায় পৌঁছার পর যখন মাইকে ঘোষণা করছে বাংলাদেশের ‘মুনতাসির সামি’ এখন থেকে একজন আয়রনম্যান। সেই মুহূর্তটি আমার স্বপ্নজয়ের সেরা মুহূর্ত হিসেবে থেকে যাবে আজীবন।
একই রকম চ্যালেঞ্জ পার করে ইমতিয়াজ ইলাহি ও আবদুল্লাহ আল ইমরানের নামও ঘোষণা হলো আয়রনম্যান হিসেবে।