‘আমার সঙ্গে মতের মিল হচ্ছে না, তার আর বাঁচার অধিকার নেই, ওকে মারো, পিটিয়ে মেরে ফেলো’। ‘ও আমার গ্রুপ করে না, ওকে শেষ করে দাও’—এমনধারা মন আর মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠছে তরুণ প্রজন্মের একাংশ! তারা নিদারুণ, নিষ্ঠুর। তারা শিখেছে, কেবল সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আরেকজনকে পেছনে ফেলতে হবে। ভালো রেজাল্ট করতে হবে। ভালো জায়গায় চান্স পেতে হবে। গাড়ি থাকতে হবে। ফ্ল্যাট থাকতে হবে। নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হবে। মানুষ হওয়ার শিক্ষা তাদের হয়নি।
‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’—এই কামনা ছাড়া বাবা-মায়েরা আর কিছু চিন্তা করতে চান না। পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নপত্রের সন্ধানে বাবার ছোটাছুটি, মায়ের টেলিফোনে সন্ধান সন্তানকে জিপিএ-৫ এনে দেয় সত্যি, কিন্তু কিছুতেই মানবিক করে না। অতি সাধারণীকরণ করে যাঁরা কেবল বিচারহীনতা আর সমাজের দোষ খুঁজে বেড়ান, তাঁরা ভাবেন না, সবাইকে নিয়েই সমাজ। সবাই সমানভাবে মানবিক হলে সমাজের বা রাষ্ট্রের সাধ্য নেই পৈশাচিকতাকে লালন করার। ক্ষমতা অনেকটা মাদকের মতো। নিষ্ঠুরতা এই ক্ষমতায় ওঠার সিঁড়ি। মাদক নিয়ন্ত্রণে তিনটি কৌশল ব্যবহার করা হয়—সরবরাহ হ্রাস (সাপ্লাই রিডাকশন), চাহিদা হ্রাস (ডিমান্ড রিডাকশন) আর ক্ষতি হ্রাস (হার্ম রিডাকশন)। এর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর হচ্ছে ডিমান্ড রিডাকশন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা। নৃশংসতা কমাতে এই ডিমান্ড রিডাকশনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সমাজ শেখাবে, ওপরে উঠতে হলে স্বার্থপর হও, নিষ্ঠুর হও, নির্মম আর নৃশংস হও, কিন্তু আমি হব না, সমাজের নেতিবাচক প্রভাব থেকে দূরে থাকাই ডিমান্ড রিডাকশন। এই নৃশংস না হয়ে ওঠার শেখাটাই পরিবার আর বিদ্যায়তনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শেখানো হয় না। বরং সেখানে শেখানো হয় কী করে আরও যোগ্য আর সফল হয়ে উঠবে! প্রয়োজনে নির্মম হও, কিন্তু সফল হতেই হবে!
সন্তানকে সফল, যোগ্য, জিপিএ-৫-ধারী, ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যাগ লাগানোর চেয়ে মানবিক বানানো অনেক বেশি জরুরি। ‘আমার ছেলে বা মেয়ে আমেরিকা/অস্ট্রেলিয়া/কানাডার অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে’ বা ‘আমার সন্তান ইঞ্জিনিয়ারিং/ডাক্তারি পড়ে’ বলে যে বাবা-মায়েরা সুখের শ্বাস ফেলেন, তাঁরা জানেন না, একদিন তাঁদের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতেই হবে যদি তাঁরা সন্তানকে মানবিক হওয়ার শিক্ষা না দেন।
শিশু যদি সব সময় হিংস্রতা, নির্মমতা আর সংঘাতময় পরিবারে বেড়ে ওঠে, পরিবারের কোনো সদস্যের মধ্যে যদি অতিমাত্রায় নৃশংসতা থাকে, স্কুলে যদি সে ক্রমাগত নিষ্ঠুর আচরণ বা উত্ত্যক্তের শিকার হয় বা কোনো শারীরিক, মানসিক বা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, মাদকে আসক্ত হয়, তাহলে আচরণে উগ্রতা তৈরি হয়। সামাজিক অস্থিরতা আর সহিংসতার মধ্যে শিশু বড় হতে থাকলে যদি কেউ মনে করে যে এই হিংস্রতার জন্য আমার কোনো বিচার হবে না, আমি পার পেয়ে যাব, সমাজ যদি নিপীড়কদের প্রশ্রয় বা বাহবা দেয়, তাদের শাস্তি না হয়, তাহলে সমাজে নৃশংসতা বেড়ে যায়, এ জন্য সমাজের প্রতিটি ক্ষুদ্র একক মানুষকে আগে মানবিক হতে হবে।
মানুষের মধ্যে এই হিংস্রতার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিয়েছে এভাবে যে একজন হতাশ মানুষ নিজের হতাশাকে কাটাতে নিজের অপ্রাপ্তিবোধের তাড়না থেকে নিজের চেয়ে দুর্বল কাউকে বেছে নেয়। আর সেই দুর্বলের ওপর হিংস্রতা দেখিয়ে একধরনের মানসিক পরিপূর্ণতা পেতে চায়। এই তত্ত্বকে বলা হয় ‘ফ্রাস্ট্রেশন-অ্যাগ্রেসনহাইপোথিসিস’। এ কারণেই আমরা দেখি দুর্বলের ওপর অপেক্ষাকৃত সবলের আস্ফালন ও হিংস্রতা।
পরিবার ও স্কুলের ভূমিকা
নৃশংসতা কমাতে আর মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ গড়তে পরিবার ও স্কুলের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। নৃশংস আচরণের জন্য দায়ী বিষয়গুলো ছোটবেলায় চরিত্রের মধ্যে প্রবেশ করে, যেটাকে বলা হয় সাইকোসোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, যার মধ্যে আছে কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট (ধারণার জগতের বিকাশ) আর মোরাল ডেভেলপমেন্ট (নৈতিকতার বিকাশ)। এই দুটি বিকাশ যদি সুষমভাবে না হয়, তবে আইন করে আর বড় বড় শাস্তি দিয়ে নৃশংস আচরণ কমানো যাবে না। এ জন্য পরিবার আর স্কুলে যেসব বিষয়ের দিকে জোর দিতে হবে, সেগুলো হচ্ছে:
পরিবারে সহিংসতার উদাহরণ না থাকা
মা-বাবা সব ধরনের ঝগড়া-বিবাদ থেকে দূরে থাকবেন। নিজেদের মধ্যে তো বটেই, এমনকি বাইরের মানুষের সঙ্গে কোনো বিবাদে জড়াবেন না। সন্তানের সামনে কোনো ধরনের সহিংস আচরণ করবেন না।
ভিন্নমতের প্রতি সম্মান দেখানো
পরিবার আর স্কুলে ভিন্নমতের প্রতি সম্মান দেখানোর চর্চা থাকতে হবে। সন্তানের সামনে আরেকজনের ধর্ম বা রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে মোটেই কটূক্তি করবেন না। অনেক শিক্ষিত (তথাকথিত) মানুষও সন্তানের সামনে ভিন্নধর্মের/রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ নিয়ে ব্যঙ্গ/কটূক্তি করেন। স্কুলে ধর্মভিত্তিক সেকশনে শিক্ষার্থীদের বিভাজন করা হয়। এতে ভিন্নমতের প্রতি সম্মানবোধ তৈরি হয় না।
আইন মেনে চলার প্রবণতা
অনেক অভিভাবক সন্তানের সামনে বলেন, ‘বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই’, ‘এ দেশের সব খারাপ’, ‘এ দেশে আইন মেনে চললে কিছুই হবে না’। সন্তানের সামনে তাঁরা নিজেরাও আইন ভাঙেন। রাস্তার উল্টো দিক দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলেন, লাইনে দাঁড়াতে চান না। এ ধরনের আইন ভাঙার দৃষ্টান্ত তাঁরা সন্তানকে দেখান। সেখান থেকে সন্তান ভাবতে শেখে, এ দেশে সবকিছু বেআইনিভাবে করতে হবে। আইনের প্রতি সে শ্রদ্ধা হারায়।
সহনশীলতার শিক্ষা
সবকিছু নিজের পক্ষে সব সময় থাকবে না। নিজের পক্ষে যেটা থাকে না, সেটা মেনে নেওয়ার শিক্ষা সন্তানকে পরিবারে আর স্কুলে শেখাতে হবে।
ব্যর্থতাকে মেনে নিতে হবে
জীবনের সফলতার মতো ব্যর্থতাও রয়েছে। ব্যর্থতাকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। ব্যর্থতা মানেই জীবন শেষ নয়। সহজে হতাশ হওয়া যাবে না। শিশুকে টার্গেট ঠিক কেও দেওয়া চলবে না।
মন্দ উদাহরণ নয়
শিশুর সামনে এমন কোনো আচরণ করবেন না, যাতে সে মনে করে, দাম্ভিকতা, উগ্রতা আর হিংস্রতা মানেই সক্ষমতা ও সফলতা।
সুসংগঠিত পারিবারিক কাঠামো গড়ে তুলুন
পারিবারিক কাঠামো যেন অসম্পূর্ণ না হয়, পরিবারের সবাই যেন মিলেমিশে থাকে। পরিবারে সহনশীলতা আর মিলেমিশে থাকার চর্চা থাকলে তা সমাজে প্রতিফলিত হবেই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালো রেজাল্টের কারখানা নয়
স্কুল, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালো রেজাল্টের কারখানার বদলে মানুষ গড়ার বিদ্যাপীঠ হিসেবে রূপান্তরিত করতে হবে। ‘রেজাল্টভিত্তিক সমাজ’-এর বদলে ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ’ কাঠামোর কথা ভাবতে হবে।
শিশুদের রাখতে হবে নিরাপদ
শিশু যেন কোনো অবস্থাতেই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার না হয়। নিপীড়নের শিকার শিশুদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে নানা সহিংস আচরণ দেখা দিতে পারে।
গেজেটের ব্যবহার হোক পরিমিত
মুঠোফোন, ট্যাব, ল্যাপটপের ব্যবহার হোক পরিমিত। এগুলোয় শিশু এমন কোনো গেম খেলবে না, যা সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে, সহিংস আচরণ বাড়াতে পারে। সাইবার বুলিং থেকে শিশুকে নিরাপদ রাখুন।
শিশুর আচরণগুলো লক্ষ রাখুন
কনডাক্ট ডিজঅর্ডার, পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার বা মাদকের প্রভাবে শিশু-কিশোরদের আচরণ আগ্রাসী হতে পারে। এ ধরনের আক্রমণাত্মক আচরণ কোনো শিশু-কিশোরের মধ্যে দেখা গেলে তাকে চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকুক
অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নজরে রাখতে হবে যেন ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকে।