বাবা, তোমাকে বলা হয়নি

আমার যোদ্ধা বাবা

আজ জুন মাসের তৃতীয় রোববার, বাবা দিবস। বিশেষ এই দিন উপলক্ষে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল গোদরেজ প্রটেক্ট ম্যাজিক হ্যান্ডওয়াশ ও প্রথম আলো অনলাইন। ‘বাবা, তোমাকে বলা হয়নি’ শিরোনামে বিপুলসংখ্যক পাঠক লিখেছেন তাঁদের মনের কথা। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি প্রকাশিত হলো এখানে।

বাবা ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে লেখক
বাবা ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে লেখক

আজ বাবা দিবস।

আব্বু, গত বছরও এই দিনে তুমি ছিলে। কে জানত, এ বছর থাকবে না। তুমি জানো, আব্বু? তোমার চেম্বার, তোমার ছোট হাসপাতালজুড়ে এখন শুধুই শূন্যতা। শূন্যতা তোমার বাড়িতে, আমাদের মনে। তোমাকে না দেখার, কাছে না পাওয়ার শূন্যতা। যেখানে রোগীর ভিড়ে গমগম করত পুরো এলাকা, যানজট লেগে যেত তোমার চেম্বারের আশপাশে। সেখানে এখন কেবলই নীরবতা। তোমার চেম্বারের মতো তোমার রোগীরাও ছিল অতি সাধারণ। বিনা পারিশ্রমিকে, কিংবা নামমাত্র ফি নিয়ে চিকিৎসা করেছ লাখো মানুষের। রোগীদের ওপর তুমি কখনোই নানা স্বাস্থ্য পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দিতে না। সে জন্যই হয়তো মানুষ তোমার ওপর আস্থা রেখেছিল।

গত বছর জুনের ২০ তারিখে, অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে তুমি করোনা পজিটিভ হয়েছিলে। কিন্তু তোমার বিশ্বাস ছিল, তোমার কিছুই হবে না। মাত্র ১০ দিনের মধ্যেই জুনের ৩০ তারিখে তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে, সবার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে। তুমি আমাদের শিখিয়েছ—সাধনা, শ্রম, একাগ্রতা কখনো বৃথা যায় না। তুমি বলতে, ‘ইউ শুড রিড আ বুক ফ্রম কভার টু কভার’। তুমি বলতে, চিকিৎসা দেওয়া তোমার কাছে অক্সিজেন নেওয়ার মতো৷ গ্রামের সাধারণ মানুষকে মাস্কের ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করতে তুমি প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছিলে, ছাপাও হয়েছিল।

এই করোনার সময়ে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে সাধারণ মানুষকে সেবা দিয়েছ। সিসিইউতে নেওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত তুমি অক্সিজেন নেওয়া অবস্থায় ফোনে মানুষকে চিকিৎসাসংক্রান্ত পরামর্শ দিয়ে গেছ। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরও তোমার মনোবল ভাঙেনি একটুও। তোমার বিশ্বাস ছিল, ভালো হয়ে যাবে।

এখনো আমি চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট দেখতে পাই—৩০ জুনের সব ঘটনাক্রম। তুমি বারবার ইশারায় জিজ্ঞাসা করছিলে, স্যাচুরেশন কত। তোমার অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগল। তোমার ফুসফুস কাজ করা বন্ধ করে দিল। তোমার স্যাচুরেশন নেমে এল ৬৭–তে। আমি মনিটরে দেখছিলাম, তোমার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হার মানছে। এরপর দ্রুত তোমার স্যাচুরেশন নেমে এল শূন্যতে। কিন্তু তোমার হৃৎস্পন্দন তখনো চলছিল। আমার ভাইসহ অন্য সব ডাক্তার, তোমাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। সবাই তোমার পাশে ছিল। কিন্তু তোমার ফুসফুস কাজ করছিল না। আমি আর আমার ভাই কালিমা, সুরা মুলক, সুরা ইয়াসিন পড়ছিলাম। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না তুমি মারা গেছ।

আব্বু তুমি তো ফাইটার, তুমি যোদ্ধা, সব যুদ্ধে তুমি বিজয়ী। তুমি করোনার সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যাবে, বিশ্বাস হয়নি। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল তোমাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাই।

প্রতিদিন মনে মনে বলতাম, তুমি যেদিন ভালো হবে, সেদিন তোমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরব। বলব, আব্বু আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তুমি আমাদের গর্ব। আর কখনো এসব কথা বলা হবে না। তুমি তো মানুষকে চিকিৎসা করতে গিয়ে করোনা পজিটিভ হয়েছিলে। সবাই তো মানুষকে ভালোবাসার কথা বলে, কিন্তু কজন পারে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে মানুষকে ভালোবাসতে।

তুমি আমাদের শিখিয়েছ মানুষকে ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ। নিজের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে তুমি এই মহামারি করোনার সময় অতি সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করেছ, যেন গরিব-অসহায় রোগীরা সেবা পায়। তোমার স্বপ্ন ছিল, তুমি মিরসরাইয়ে তোমার জায়গায় অনেক বড় করে হাসপাতাল বানাবে। তোমার সেই স্বপ্ন তুমি পূরণ করে যেতে পারলে না।

নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাকে তোমার পরিশ্রমের যথোপযুক্ত পুরস্কার দেবেন। কিন্তু আমরা তোমাকে ছাড়া বড় অসহায়। কেন চলে গেলে আব্বু?