প্রায় দিনই সন্ধ্যায় গল্পের আসর বসত বাসায়। আমার বাবা গুরুপ্রসন্ন দাশগুপ্ত তাঁর বাল্য থেকে যৌবন পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে কাটানো স্বপ্নময় দিনগুলোর কথা বলতেন। বাবা যখন তাঁদের এই গল্পগুলো বলতেন, মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, খুব আনন্দ পেতাম। তাঁর স্কুল ফাঁকি দেওয়ার কথা ভেবে কেমন যেন গর্বও হতো, আমার বাবা কত দুষ্টু ছিলেন।
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে বাবা কলকাতায় পরলোকগমন করেন ১০৪ বছর বয়সে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে গড়ে ওঠা এই মানুষ ছিলেন নিভৃতচারী। এখন ভীষণ অনুতাপ হয়, কী মূর্খ ছিলাম—বাবা যখন জীবনের গল্প করতেন, তার সন, তারিখ কিছুই মনে রাখিনি। মনে হতো সবই তো আমার বাবার গল্প। আজ সব হারিয়ে মনে হয়, কী দুর্ভাগ্য, এত সব মণিমুক্তাময় স্মৃতির প্রায় অনেকটাই মনে করতে পারি না। তবে বাবাসহ আমাদের পরিবারের সদস্যরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছিলেন, সেসব কথা ভুলি কী করে।
ব্রিটিশ আমলের কথা বলছি। হবিগঞ্জ শহরের নবীগঞ্জ থানার গুজাখাইর গ্রামের জমিদার ছিলেন আমার দাদু শ্রীসুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। কিন্তু জমিদারির বিলাসিতায় জীবন না কাটিয়ে তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হিসাব বিভাগে যোগ দেন। তাঁর কর্মস্থল ছিল অবিভক্ত ভারতবর্ষের মণিপুরে। প্রকৃতির এক অপূর্ব লীলাভূমি মণিপুর।
আমার দাদু তাঁর সন্তানদের মণিপুরের স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করান। প্রতিদিন সকালে ছেলেরা স্কুলে যায়, ছুটির পর যথাসময় বাড়ি ফিরে আসে। বেশ চলছিল আমার বাবা, জ্যাঠা ও কাকাদের জীবন। কিন্তু একদিন স্কুলের প্রধান শিক্ষক দাদুকে জানান যে তাঁর ছেলেদের স্কুলে উপস্থিতির হার খুব কম। বেচারা দাদু আকাশ থেকে পড়লেন। তাহলে ওরা বাসা থেকে বের হয়ে যায় কোথায়? জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে এল, তাঁরা স্কুলে ঠিকই রওনা দেন, পথিমধ্যে জামাকাপড় খুলে নদীতে সাঁতার কেটে ও নানা ধরনের দুষ্টুমি করে স্কুল ছুটির সময় সুবোধ বালকের মতো ফিরে আসেন।
এ ঘটনায় মোড় নিল এক নতুন অধ্যায়ে। দাদু সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁর তিন ছেলে ও তিন মেয়েকে শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর আশ্রমে দিয়ে আসবেন। এটুকু তো অনেকের জানা, ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন ‘পাঠভবন’, যা প্রচলিত বা গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থার ধারণাকে ভেঙে নতুন এক দিগন্তের সূচনা করে। শিক্ষাকে
চার দেয়ালের গণ্ডি থেকে বের করে নিয়ে আসেন প্রকৃতির কোলে। পরবর্তীকালে যা ক্রমেই বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়।
আমার বড় পিসির তখন বিয়ের বয়স অর্থাৎ ১৪-১৫ বছর বয়স। তাই তাঁর যাওয়া হলো না। ছোট তিন ছেলেমেয়ে অনেক ছোট, তাই তাঁদেরও যাওয়া হলো না। আমার জ্যাঠামশাই হরপ্রসন্ন দাশগুপ্ত, আমার বাবা গুরুপ্রসন্ন দাশগুপ্ত, আমার আরেক কাকা শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (যাঁকে আমরা তাতু ডাকতাম, বীর মুক্তিযোদ্ধা বিধু বাবু নামে যিনি সুপরিচিত।) গেলেন পড়তে। এ ছাড়া আমার মেজ পিসি লক্ষ্মীপ্রভা দাশগপ্ত, সেজ পিসি কালীপ্রভা দাশগুপ্ত ও রাঙা পিসি শক্তিপ্রভা দাশগুপ্ত। সেটা যে কত সাল তা বলতে পারছি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমার বাবা দেশ পত্রিকার সাবেক সম্পাদক সাগরময় ঘোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহপাঠী ছিলেন। দাদু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য একটি লাঠি নিয়ে গিয়েছিলেন উপহার হিসেবে। কবিগুরু অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন সুদূর মণিপুর থেকে একজন ভদ্রলোক তাঁর ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছেন তাঁর হাতে সঁপে দিতে।
শান্তিনিকেতনের প্রকৃতির কোলে মিশে গিয়ে বাবারা মানিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু ছোট থাকায় আমার রাঙা পিসি (শক্তিপ্রভা দাশগুপ্ত) খুব কান্নাকাটি শুরু করায় তাঁকে ও আমার তাতুকে (বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত ওরফে বিধুবাবু) মণিপুরে ফিরিয়ে নিয়ে যান দাদু। এ জন্য পরবর্তীকালে রাঙা পিসিকে দুঃখ করতে শুনেছি।
তাঁর মতে, ছোট হিসেবে তাঁর কাঁদাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়ায় তিনি একটি স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আমার জ্যাঠামশাই হরপ্রসন্ন দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব স্নেহভাজন ছিলেন। আমার সেজ পিসি কালীপ্রভা দাশগুপ্ত কবিগুরুর খুব প্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী। তাঁকে কবিগুরু লিখেছিলেন একটি সরস কবিতা, ‘উঁচু গাছে চড়ে বসে, মণিপুরি নাচ নাচে। রং তার কালো নয়, নাম তার কালী। কালী, তোর নাম কে রাখিল কালী?’ সেজ পিসির সঙ্গে পড়তেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। তাঁরা একই ‘কালচারাল ট্রুপে’র সদস্য ছিলেন। সেটা ১৯৩৪-৩৫ সাল হবে। পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেজ পিসি তাঁকে সেই ছবিটা উপহার দিয়েছিলেন। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। আমৃত্যু তাঁর যোগাযোগ ছিল আমার সেজ পিসির সঙ্গে। ছবিটা দিল্লিতে ‘ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়ালে’ এখনো সযত্নে সংরক্ষিত। আমার মেজ পিসি ও সেজ পিসির বিয়েতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশীর্বাদ জানিয়ে টেলিগ্রাম করেছিলেন, যেটি আমাদের ড্রয়িং রুমে বাঁধানো ছিল ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। ১৯৭১ সালে বাড়িঘর লুট ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ায় বহু অমূল্য ছবি ও বইপত্র ধ্বংস হয়ে যায়। এমনকি কবিগুরুর লেখা বেশ কয়েকটি চিঠি ছিল আমার জ্যাঠামশাই ও বাবার কাছে—সেসবও। এখনো কিছু ছবি রয়েছে আমাদের সংগ্রহে। সেসব
ছবিই স্মৃতি।
লেখক: শিক্ষক এবং গুরুপ্রসন্ন দাশগুপ্তের মেয়ে