প্রথমবার ক্লাসে মেয়েটাকে দেখে মনে হয়েছিল, সে ভালো ছাত্রীদের দলে। একটা অঙ্ক বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল বলে সাহায্যের জন্য গিয়েছিলাম ওর কাছে। কথা বলে জানলাম, আসলে ঘটনাটা উল্টো। বাসায় পড়ালেখা করতে ইচ্ছে করে না বলেই ক্লাসের কোনো কিছু মিস করতে চায় না সে। এভাবে আমাদের বন্ধুত্বের শুরু। তখনো জানতাম না শমী হাসান চৌধুরী নামের মেয়েটির মধ্যে কী অসাধারণ প্রাণশক্তি লুকিয়ে আছে।
প্রথমে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে আমরা একসঙ্গে পড়েছি, পরে দুজনেই ইউনিভার্সিটি পুত্রা মালয়েশিয়া থেকে অর্থনীতি ও ব্যবস্থাপনায় স্নাতক শেষ করেছি। এরই মধ্যে সমাজসেবা ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের জন্য কত কী পুরস্কার যোগ হয়েছে আমার এই বন্ধুর ঝুলিতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পুত্রা আইকন অ্যাওয়ার্ড, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে পাওয়া প্রেসিডেন্ট’স ভলান্টিয়ার সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড, যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের পক্ষ থেকে পাওয়া ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড। কমনওয়েলথ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের এশিয়া অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেছে সে।
শমী একজন সমাজকর্মী। নিরাপদ পানি, পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা (ওয়াশ) নিয়ে কাজ করে। কেন এ ধরনের কার্যক্রমে যুক্ত হলো, এর পেছনে একটা অসাধারণ গল্প আছে। ২০১৪ সালে মাত্র এক দিনের ডায়রিয়ায় ভুগে মারা গিয়েছিলেন শমীর মা। ব্যাপারটা শমী মেনে নিতে পারেনি। মায়ের মৃত্যু কদিন পরই নিরাপদ পানি, পয়োনিষ্কাশন ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে সে গিয়েছিল দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে। আমার ভাবলেই অবাক লাগে, ওই টুকু একটা মেয়ে কীভাবে তাঁর শোককে শক্তিতে পরিণত করেছিল এবং এরপর সে আর কখনো থামেনি।
একদিন একটা রেস্টুরেন্টে বসে বারগার খেতে খেতে আমরা আলাপ করছিলাম, কীভাবে তরুণদের সংঘবদ্ধ শক্তিকে কাজে লাগানো যায়। একদম খেলাচ্ছলে গল্প করতে করতেই ঠিক করে ফেললাম, আমরা এমন একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করব, যেখানে আমাদের মতো উৎসাহী তরুণেরা কাজ করবে। শমী বলল, সে ওয়াশ নিয়ে কাজ করতে চায়। আমি বললাম মানসম্পন্ন শিক্ষা নিয়ে আমার আগ্রহের কথা। আমরা জাতিসংঘের বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনে কাজ করতে চেয়েছিলাম। এভাবেই জন্ম হলো আমাদের সংগঠন, অ্যাওয়ারনেস থ্রিসিক্সটির।
একবার শুরু করার পর আমরা আর পেছনে তাকাইনি। ২৩টি দেশের তরুণেরা আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। শমীর একজন সহকর্মী হিসেবে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। আমাদের অনেক বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আমরা দুজন সবচেয়ে কাছের বন্ধু। কিন্তু কাজের বেলায় শমী পুরোদস্তুর পেশাদারি। মানের ব্যাপারে কোনো আপস করে না।
ওর উদ্যম সব সময় আমাকে অবাক করে। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ধুম করে মঞ্চে উঠে হাজারো মানুষের সামনে সে একটা দুর্দান্ত বক্তৃতা দিয়ে ফেলে, ১০ মিনিটে ব্যাগ গুছিয়ে এক মাসের মধ্যে পাঁচটি দেশ ভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়ে, দিনের পর দিন হাসপাতালে অসুস্থ বন্ধুর পাশে থাকে, পরিবারের দায়িত্ব নেয়, সারা রাত জেগে কাজ করেও পরদিন টেডএক্স টকের আয়োজনে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়, ওর গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না।
মনে আছে, মালয়েশিয়ায় আমরা একবার একটা বৃক্ষরোপণ কার্যক্রমে গিয়েছিলাম। সবাই যখন গাছ লাগিয়ে ক্লান্ত হয়ে খেতে বসেছি, একটা খাবারের প্যাকেট নিয়ে শমী ঠিকই ছুটে গিয়েছিল সেই ট্রাকচালকের কাছে, যিনি গাছগুলোসহ আমাদের পৌঁছে দিয়েছিলেন। এমন ছোটখাটো বিষয়গুলো কখনো ওর চোখ এড়িয়ে যায় না। আমার মনে আছে, টিউশনির টাকা দিয়ে সে তার বাড়ির গৃহকর্মীকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। শমী শুধু তাঁকে একটা অসাধারণ দিন উপহার দিতে চেয়েছিল। তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
আমি বিস্ময় নিয়ে দেখেছি, কী অবলীলায় শমী যৌনকর্মী, রিকশাচালক, বস্তিবাসী থেকে শুরু করে হলিউডের তারকা কিংবা একটা দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও বন্ধুর মতো কথা বলে। নানা দেশ ঘুরে বেড়ানোর সময় ওর ব্যাগে থাকে বাংলাদেশের পতাকা।
আমরা দুজন একই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করি। তবু টের পাই, আমার চেয়ে শমীর লড়াইটা বেশি কঠিন। দৃঢ় মনোবল দিয়েই সে সব বাধা পেরিয়ে গেছে। সামনেও নিশ্চয়ই পেরিয়ে যাবে।
লেখক: সহপ্রতিষ্ঠাতা, অ্যাওয়ারনেস থ্রিসিক্সটি