>বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ৮০ বছর পূর্ণ হচ্ছে ২৫ জুলাই। আশিতেও তিনি নতুন ভাবনায় উজ্জীবিত। ছুটির দিনের সঙ্গে আড্ডায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বললেন তাঁর বর্ণিল জীবনের কয়েকটি অধ্যায়।
দেয়ালের ফ্রেমে বাঁধা দুটি ছবিতে চোখ আটকে গেল। সাদাকালো যুগের প্রথম ছবিতে স্থির হয়ে আছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। পাশে তাঁর স্ত্রী রওশন আরা সায়ীদ এবং দুই মেয়ে রঞ্জনা সায়ীদ ও লুনা সায়ীদ। স্টুডিওতে তোলা ছবিটিতে মা–বাবার কোলে বসে আছে ছোট্ট রঞ্জনা আর লুনা।
ছবিটি বহু পুরোনো।
দ্বিতীয় ছবিও সায়ীদ–দম্পতির। বছর সাতেক আগে তোলা। রঙিন এ আলোকচিত্রে তাঁদের সঙ্গে উপস্থিত তাঁদের দুই মেয়ের সন্তানেরা—মিত্রা, শঙ্খমালা ও দীপান্বিতা।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বসার ঘরের সাদা দেয়ালে সুখী পরিবারের উজ্জ্বল চিহ্ন হয়ে সগৌরবে পাশাপাশি ঝুলে থাকা ছবি দুটি তাঁর সময়যাপনের কথাও তো বলে। এক জীবনে কত জীবনই না যাপন করেছেন! ২৫ জুলাই তিনি পূর্ণ করবেন ৮০ বছর। ‘জীবন গিয়াছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার’ বলে তিনি কি কখনো তাকান পেছন ফিরে?
১৯৬৫ সালে বের করলেন সাড়া জাগানো ছোটকাগজ কণ্ঠস্বর, শুরু করলেন নতুন সাহিত্য আন্দোলন; এরপর বেশ কিছুকাল টেলিভিশনে অসাধারণ সব অনুষ্ঠান উপস্থাপনার ঘোরগ্রস্ত জীবন; তারপর ১৯৭৮–এ গড়ে তুললেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বই পড়ানোর মধ্য দিয়ে আলোকিত মানুষ গড়ার সেই অনিন্দ্য সংগ্রামের ৪০ বছর পার হয়েছে গেল বছর। বইপড়াসহ নানামুখী কার্যক্রমে ৪০ বছরে ১ কোটি মানুষকে সরাসরি স্পর্শ করেছ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের আকাঙ্ক্ষা, আগামী ১০ বছরে আরও ১ কোটি মানুষের কাছে বই নিয়ে পৌঁছাবে প্রতিষ্ঠানটি।
এত বিপুল কর্মযজ্ঞের যিনি অধিনায়ক, রবীন্দ্রনাথের মতো তিনি তো বলতেই পারেন, ‘এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি।’ তেমন কোনো কথা কি তিনি বলবেন, জানার জন্য আমরা অপেক্ষা করছিলাম তাঁর বাসায়। ১৫ জুলাই সকালবেলা। তখনো বসার ঘরে পড়েনি তাঁর দীর্ঘ ছায়া। ঘরভর্তি বই, এর মধ্যে কেন যেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের পারিবারিক ওই দুটি ছবিতেই থিতু হলো আমাদের চোখ। আর সেখানে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে আরও মনে পড়ল, মানুষটির কর্মকাহিনি তো এখানেই শেষ নয়, যৌবনের প্রারম্ভ থেকে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, আত্মস্মৃতি মিলিয়ে লিখেছেন বিস্তর; সক্রিয় আছেন নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে; আর শিক্ষকতা, সে তো প্রবাহিত তাঁর রক্তের ভেতরে।
তিনি এলেন
‘কী হে...’, পরিচিত উচ্চারণে ছোট্ট এক টুকরো কথা। ছবি থেকে চোখ সরাতেই দেখি আমাদের সামনাসামনি সোফায় বসে আছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। একথা–ওকথার পর কথা ভিড়ল তাঁর ৮০ বছরে, ‘এই যে ৮০ বছরের জীবন, এ জীবন নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে, স্যার?’
‘কোনো আক্ষেপ নেই। আগে জানতাম যে গৌতম বুদ্ধ ৮০ বছর বেঁচে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথও তাই। সেই ৮০ বছর তুচ্ছ এক মানুষ হিসেবে আমিও পেয়ে গেলাম। এরপর আর জীবন নিয়ে দুঃখ পাওয়ার কোনো কারণ আছে?’
‘একবার আমার কাছে একজন তাঁর জীবনের নানা কিছু নিয়ে অভিযোগ করলেন। তাঁকে আমি বললাম, “কাল সকালে কি দিয়ে নাস্তা করলেন?” তিনি বললেন। এবার বললাম, “বেশ ভালোই তো নাশতা করেছেন। বহুদিন তো এভাবেই নাস্তা করছেন। দুপুরের খাওয়া কখনো বাদ গেছে?’ মাথা ঝাঁকালেন তিনি, “না, সেটা হয়নি।” “আপনি যে পড়াশোনা করলেন, এত বড় হলেন, এতে কোনো অসুবিধা হয়েছে?” “না, কোনো অসুবিধা হয়নি।” এ পর্যায়ে আমার প্রশ্ন, “যা চেয়েছিলেন তার মধ্যে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো জায়গায় কোনো কমতি আছে?” তিনি বললেন, “না, তেমন কিছু নেই।” তখন তাঁকে বললাম, “এগুলো তো বলেন না, সবসময় কোনটা পাননি সেটা বলেন। এই সুন্দর পৃথিবীতে কজনের ভাগ্য হয় এমন মধুময় সময় কাটানোর? কজন পারে মধুর জীবন কাটিয়ে জীবন পার করতে?” এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কথা মনে পড়ছে, “কী পাইনি তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি।”’
কথা শেষে চিরচেনা সেই প্রসন্ন হাসি। জানতে চাইলাম তাঁর জীবনের গল্প। তিনি বললেনও নিজের জীবনের নানা পর্বের কথা। আর সেসব কথার ভিড়ে স্বপ্নের সমান বড় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তো মূর্ত হলেনই, উপরন্তু আমরা পেলাম বাড়ির বড় ছেলে ‘লালু ভাই’কে। পাঁচ বোন, ছয় ভাইয়ের মধ্যে তিনিই বড়। তাই সবার কাছে ছিলেন লালু ভাই। বাবা আযীম উদ্দীন আহমদ ছিলেন নামজাদা অধ্যক্ষ। ১৯৩৯ সালে জন্মের পর থেকে দেখেছেন বাবার ঘরভর্তি বই, তিনি লেখাপড়ায় নিমগ্ন। এ স্মৃতি আজও অমলিন তাঁর চোখে, ‘তখন আমি খুব ছোট। নিজের পড়ার ঘরে আব্বা আমাকে ডাকলেন। বললেন, “দ্যাখ, তোর বয়স কম। কিন্তু তোকে একটা কথা বলি। এখন হয়তো বুঝবি না, কিন্তু মনে রাখিস, নলেজ ইজ পাওয়ার।”’
সেরা পেশা শিক্ষকতা
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের চোখে শিক্ষকতাই মানুষের সেরা কাজ। বাবাকে দেখে বালকবেলাতেই সংকল্প করেছিলেন, জীবনে কিছু হলে শিক্ষকই হবেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ১৯৬১ সালে ২২ বছর বয়সে মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজে সায়ীদের যখন শিক্ষকতার শুরু, তখন ওই কলেজে অধ্যক্ষ ছিলেন তাঁরই বাবা। তিনিই ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তার ভেতরে যেহেতু শিক্ষকের রক্ত আছে, আমি বিশ্বাস করি সে ভালো শিক্ষক হবে।’
ভালো শিক্ষক কি আপনি হতে পেরেছেন?
‘যে শিক্ষক হতে পারলে সবচেয়ে খুশি হতাম, সেটা হয়তো আমি হয়ে উঠতে পারিনি। আমরা যেভাবে চাকরি হিসেবে শিক্ষকতাকে নিয়েছি, বিষয়টা আসলে সে রকম নয়। ক্লাসে আমি কোনোদিন উপস্থিতি নিতাম না। পাঠ্যবই সেভাবে পড়াতাম না। কারণ, জানতাম যে ক্লাসে আমি ওদের যতই বলি না কেন ওরা নোটই লিখবে, আমার কথা লিখবে না। তবে আমি চেষ্টা করেছি সাহিত্য দিয়ে, বড় জীবনের স্বপ্ন দিয়ে আমার শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করতে। শিক্ষকতাকে আমি আমার মতো করে দেখেছি। প্রতিবছর একই বিষয় পড়ালেও প্রতিবার আমি নতুন কথা বলেছি। আমি মনে করি, শিক্ষক যতটা না বেশি জ্ঞান দান করেন, তার চেয়ে বেশি প্রাণ জাগান। সেটা আমি পেরেছি। সেই জায়গাতে হয়তো আমি আমার সেরাটা দিতে পেরেছি।’
একদিন মন খারাপ করেছিলেন বাবা
শিক্ষকতায় যে মানুষটি নিজের সেরাটা দিতে চেয়েছেন সবসময়, যাঁর বুকে তাঁর বাবাই বুনে দিয়েছিলেন জ্ঞান ও শিক্ষকতার বীজ, সেই বাবাই আবার কোনো এক দুর্বল মুহূর্তে কিঞ্চিত মন খারাপ করেছিলেন ছেলের পেশা নিয়ে।
গল্পটি বলতে গিয়ে সায়ীদ হাতড়ালেন পুরোনো দিনের স্মৃতি, ‘তখন সবেমাত্র শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিয়েছি। এর কয়েকদিন পরে আমার যেসব বন্ধুরা সদ্য সিএসপি হয়েছে, তারা এল আমাদের মুন্সীগঞ্জের বাসায়। আব্বা সেদিন আমাকে একবার বলেছিলেন, “তুইও তো সিএসপি পরীক্ষাটা দিতে পারতি।” সে সময় তাঁকে বলেছিলাম, “আপনাকে দেখেই তো আমি শিক্ষক হতে চেয়েছি। এ কথার পর সেই আব্বা যে লজ্জা পেলেন, আর কখনো এ ধরনের কথা বলেনি, বরং আমার শিক্ষক পরিচয় নিয়ে গর্বই করতেন তিনি।’
নায়ককে ‘না’
শিক্ষকতার কারণেই ষাটের দশকে একদিন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রে নায়ক হওয়ার প্রস্তাব। তাঁর মুখের কথা শোনা যাক, ‘টেলিভিশনের এক ভদ্রলোক একটা চলচ্চিত্র বানাবেন। আমাকে তিনি তাঁর চলচ্চিত্রের নায়ক করতে চাইলেন। তখন আমি ঢাকা কলেজে পড়াই। তাঁকে বললাম, “আমি শিক্ষক মানুষ, চারিদিকে আমার এত ছাত্র, আমি কীভাবে নায়ক হব? নায়িকার হাত ধরে সমুদ্রের পারে, পাহাড়ের চূড়ায় হাঁটব? এটা আমি পারব না।” আমি জাহানারা ইমামের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি ছিলেন খুব আধুনিক মানুষ। তিনি আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, “আপনি তো আধুনিক শিক্ষক, আপনি এটা করতেই পারেন। শিক্ষক মানে যে “‘দেবতা”’ হয়ে সন্ন্যাস নিয়ে থাকা, তা তো নয়।” তাঁকে বললাম, “শিক্ষককে ছাত্রদের কাছে দেবতা হতে হয় না, তবে দেবতার মতো কিছু একটা হতে হয় বৈকি। না হলে আমরা কাদের দ্বারা প্রভাবিত হব? শিক্ষক দেবতা হোক আর না হোক, তার মাঝে বড় কিছুর অনুভব থাকা চাই।”
‘শেষ অবধি ওই পরিচালক ভদ্রলোক আমাকে বোঝাতে শুরু করলেন, চরিত্রটা কতটা নিরাপরাধ, বিলাতফেরত ডাক্তার, এমন কোনো বিব্রতকর দৃশ্য নেই। কিন্তু আমি আর করিনি। আমাদের সময়ের খুব বড় একজন নায়ক ওই চরিত্র করেছিলেন। সিনেমা হলের সামনে নায়ক–নায়িকাদের বড় ছবি টানানো হলো, কাটআউট বসানো হলো। দেখা গেল, সেই নিরপরাধ, নিষ্পাপ নায়ক নায়িকাকে আলিঙ্গন করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভাবলাম, হায়রে, এটাই যদি আমি করতাম, তাহলে আজ কী হতো! আজও আমার মনে হয়, ঠিক সিদ্ধান্তই আমি নিয়েছিলাম। কারণ, জীবনে এত বৈপরীত্য থাকলে মুশকিল।’
প্রাণ জাগানোর কাজ
কোনো বৈপরীত্যে না গিয়ে তিনি নিয়েছিলেন শত–সহস্র প্রাণ জাগানোর কাজ। আর এই কাজ করতে গিয়েই আরও অনেক কিছুই করা হয়নি তাঁর।
ষাটের দশকে তাঁর সাহিত্যিক বন্ধুদের কাছে যিনি ছিলেন ‘পূর্ব বাংলার বুদ্ধদেব বসু’, সে সময় সবাই যখন ভেবেছিলেন, সাহিত্য সমালোচনা ও প্রবন্ধ সাহিত্যে আরও অনেক কিছু করবেন তিনি, করেননি সেসবের অনেক কিছুই। কেন করতে পারেননি, দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে তার জবাব দিলেন নিজেই, ‘আমি লেখকের বংশে জন্মেছি। আল মাহমুদের একটা কবিতা আছে না, “পক্ষীকুলে জন্ম ওরে, তুই শুধু উড়াল শিখলি না।” আমার অবস্থাও হয়তো তেমনই।
‘সত্যি বলতে লেখককে খুব স্পর্শকাতর হতে হয়, তাঁকে সবার অনুভূতি বুঝতে হয়। একজন লেখকের হৃদয় খুব সামান্যতেই রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। বাস্তব জীবনের কাজ আমার ভেতরের ওই সত্তাকে হয়তো দৃঢ় হতে দেয়নি। সাংগঠনিক কাজ এত কঠিন, এত রূঢ় বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, যার আঘাত শিল্পীর হৃদয় সহ্য করতে পারে না। সে জন্য আঘাতে আঘাতে আমার ওই মনটাই আর টিকে থাকেনি। আর সময়ও কম পেতাম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রকে দাঁড় করাতে গিয়ে অনেক সময় চলে গেছে আমার।’
সত্য কথাই বটে, নিজের লেখক সত্তার দিকে না তাকিয়ে, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তুলে দিনে দিনে তিনি করে চলেছেন মানুষের প্রাণ জাগানোর কাজ, শিক্ষকতার কাজ। কাজের নিরিখে নিশ্চয় এটি ঢের বড়। তাঁর ভাষায়, ‘দেখলাম একটা জাতির মধ্যে আলো নেই। অবিকশিত অজ্ঞতা থেকে একটা জাতিকে উদ্ধার করতে গিয়ে সেই কাজ আধা পথে রেখে আমি তো চলে আসতে পারি না। পালিয়ে আসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
মুখদর্শন না করেই বিয়ে
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জীবনের বিচিত্র বন্দরে ঘুরতে ঘুরতে বর্ণময় যেসব গল্প শুনলাম, তার মধ্যে চমকপ্রদ ঘটনা আছে বিস্তর। তবে কনেকে না দেখে তাঁর বিয়ে করার ঘটনাটি হয়তো অনেকের কাছে এখন অবিশ্বাস্যই মনে হবে। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পাড়াশোনার পাট চুকানোর পরই বেজেছিল তাঁর বিয়ের বাদ্য। কিন্তু সেই সময়ের সুদর্শন যুবক সায়ীদ কনের মুখদর্শনই করলেন না বিয়ের আগে!
কেন?
উত্তরটি যেন প্রস্তুতই ছিল, ‘আমার ভেতর কোথায় যেন এক ধরনের গোপন বৈরাগ্য আছে। ছেলেবেলা থেকে আমি ভাবতাম যে নিজের জীবন আমি দান করব। আমি খুব প্রাণবন্ত আর স্বাপ্নিক ছিলাম। তো, সে সময় সংস্কৃতিচক্রের যেসব মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল, তাদের কেউ কেউ আমাকে পছন্দ করত না, এমন নয়। তবে ওই সময়ই আমি বুঝেছিলাম, এরা কেউই আমার দুঃখের সঙ্গী হবে না। তাই বিয়ের ব্যাপারটি পরিবারের ওপরেই ছেড়ে দিলাম। আমার অর্ধাঙ্গিনী ছিলেন আমার এক সহপাঠীর বান্ধবী। আমি ঠিকই করেছিলাম, বিয়ে বিষয়ে কোনো প্রত্যাশা রাখব না, যা কপালে থাকে, তা–ই মেনে নেব। কিন্তু আজ মনে হয়, আমি ভালো সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী আমার কাজে একটুও বিরক্ত করেননি, বরং যতটুকু সম্ভব সহযোগিতাই করেছেন।’
নীরব আক্ষেপ
একনাগাড়ে বলে একটু দম নিলেন। তাঁর পাঁচতলার ফ্ল্যাটের খোলা জানালা দিয়ে সকাল গড়িয়ে ততক্ষণে উঁকি দিচ্ছে মধ্যাহ্নের রোদ। রৌদ্রের আভায় আরেকটু আলোকোজ্জ্বল হয়ে গেছে তাঁর মুখ। সেই মুখের দিকে চেয়ে আলগোছে বললাম কথাটি, একজীবনে এত কাজ করলেন, সংসার–সন্তানের পেছনে সময় দিতে পারেননি সেভাবে। কোনো আক্ষেপ আছে এ নিয়ে?
এবার নরম হয়ে এল তাঁর স্বর, ‘তা আছে কিছু। আমার মেয়ে দুটো যখন ছোট ছিল, ওরা স্কুলে যেত, আর ওদের ওই চলে যাওয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম আমি। না, তারা হয়তো কখনোই বুঝত না যে তাদের নিষ্ঠুর বাবা তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের চলে যাওয়া দেখছে।’
আক্ষেপমাখা এ কথার পর ঘরের ভেতরে আমাদের ঘিরে ধরেছে নীরবতা, দুপুরটি কি একটু ভারী হয়ে উঠল!
উপলব্ধির খেরোখাতা
বয়স আশি হলেও আজও সজীব আর সক্রিয় তাঁর হৃদয়। জানতে চাইলাম, আশি বছরে পৌঁছে তাঁর উপলব্ধি। প্রথমে বললেন, ‘উপলব্ধি তেমন কিছুই না।’ এর পরই বললেন উপলব্ধজাত নতুন এক কথা, ‘মানুষের একটা জীবন ষাট বছর বয়স পর্যন্ত। এটা হলো পুরো বাস্তব স্মৃতি দিয়ে তৈরি একটা জগৎ। এ জগৎটা শেষ হয় ষাটে গিয়ে। এরপর শুরু হয় নতুন স্মৃতির জগৎ—বোধভিত্তিক, উচ্চতর মানুষের স্মৃতি। তখন মানুষ বস্তুনির্ভর স্মৃতি থেকে মনননির্ভর স্মৃতির দিকে ধাবিত হয়। তার নিজের ভেতরের মানুষটা জাগতে শুরু করে।’
আশিতেও অগ্রযাত্রা
সায়ীদ স্যার যেমন সবাইকে স্বপ্ন দেখান, তেমনি নিজেও স্বপ্ন দেখেন। এখন তাঁর স্বপ্ন নিজের লেখালেখিকে ঘিরে। বললেন, ‘আমি কিছু লিখতে চাই। জানি যে ৮০ বছর বয়সে স্মৃতি, স্বপ্ন— সবকিছুই খানিকটা ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। মানুষের জীবন যেমন মৃত্যু পথযাত্রী, তেমনি তার সৃজনশীলতারও হয়তো মৃত্যু আছে। তারপরও আমি লিখতে চাই, এখন দিনের দুই–তৃতীয়াংশ সময় আমি লেখার পেছনে ব্যায় করব। শেষ কথা হলো, লিখব...লিখতে চাই।’
এই কথার মধ্যে তাঁর যে আকুতি, তা উজ্জীবনী শক্তিতে ভরপুর এক মানুষের, যেন খানিক বাদেই ৮০ বছরের এই অগ্রনায়ক মেলে ধরবেন তাঁর পৃথিবী লেখার খাতা!