রশিদ (ছদ্মনাম) সাহেবের একমাত্র ছেলে অনিক। ছোটবেলা থেকেই যথেষ্ট মেধাবী। পড়ছে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনিককে নিয়ে বাবা-মা বেশ গর্বিত। এই বয়সের ছেলেদের নিয়ে যেসব প্রচলিত শঙ্কা বাবা-মায়ের মনে থাকে, অনিক সেগুলোর ধারেকাছে নেই। সে নেশা করে না, সিগারেটও খায় না। ঠিক সময়ে বাড়ি ফেরে। কারণে-অকারণে টাকা চায় না। নির্ধারিত কয়েকজন বন্ধু ছাড়া তেমন কারও সঙ্গে মেশে না। মাঝে মাঝে রাত জেগে বন্ধুদের নিয়ে কম্পিউটারে নানা প্রজেক্ট বানায়। এমনকি ধর্মীয় অনুশাসনও কঠোরভাবে মেনে চলে। কখনো কখনো অবশ্য বন্ধুদের সঙ্গে দিন কয়েকের জন্য ঢাকার বাইরে বেড়াতে যায়। তখন নিয়মিত বাসায় ফোন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার রেজাল্টও ভালো। অনিকের মা আরও বেশি খুশি এই কারণে যে, তাঁর ছেলে এই বয়সে প্রেমও করে না!
কিন্তু একদিন গভীর রাতে হঠাৎ বাসায় উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজন সদস্য। তাঁরা অনিকের ঘর তল্লাশি করতে চাইলেন। সেখানে পাওয়া গেল মারাত্মক অস্ত্র, জঙ্গিবাদ সমর্থক বই আর অনিকের কম্পিউটার ভর্তি জঙ্গি আক্রমণের কৌশলবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। একটি নাশকতার ঘটনায় অনিক সরাসরি জড়িত ছিল, এমন প্রমাণ বাবা-মাকে দেওয়া হলো। গ্রেপ্তার হলো অনিক। তার বাবা-মায়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
বাবা-মায়েরা অনেক সময় ধারণাই করতে পারেন না যে তাঁদের শান্ত-সুবোধ সন্তান জঙ্গিবাদ আর চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সন্তানের ভবিষ্যৎ, ক্যারিয়ার আর বাহ্যিকভাবে তার আচরণ দেখে বাবা-মায়েরা তৃপ্ত থাকলেও কখনো কখনো সন্তানের বহিরাবরণ ভেদ করে তার অন্তরের কাছাকাছি পৌঁছানো দরকার। শিশুর অন্তঃকরণ জানতে হলে তার ধারণার জগৎটি কীভাবে গড়ে ওঠে, তা বাবা-মাকে খানিকটা বুঝতে হবে।
সুইস মনোবিজ্ঞানী জ্যঁ পিয়াজে শিশুদের ধারণার জগৎ বা জ্ঞানীয় বিকাশের বিখ্যাত তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ৭ থেকে ১১ বছর বয়সের একটি শিশুর মধ্যে কংক্রিট অপারেশনাল পর্যায় দেখা যায়, যখন আশপাশ সম্পর্কে সে অনেক যুক্তি দিয়ে ভাবতে শেখে। কোনো বস্তুর ধারণায় সে গুণগত মানকে প্রাধান্য দেয়। আর ১১ বছরের পর থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত তার মধ্যে ফরমাল অপারেশনাল পর্যায় দেখা যায়, যখন তার ধারণার জগৎটি অনেক বিস্তৃত হতে থাকে, বিমূর্ত হতে থাকে এবং কার্যকারণ বিবেচনা করে সে তার ধারণা প্রস্তুত করে। এই ফরমাল অপারেশনাল পর্যায়টি এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, এই সময়টিতেই একজন তরুণের মধ্যে যেকোনো বিশ্বাস বা আদর্শ দানা বাঁধতে থাকে। এই বিশ্বাস বা আদর্শ হতে পারে পুরোপুরি আত্মকেন্দ্রিক ক্যারিয়ার-নির্ভর অথবা পার্থিব ভোগবাদে পরিপূর্ণ কিংবা পুরোপুরি পরার্থবাদী। আবার কখনো-বা হতে পারে মানবতাবিরোধী সন্ত্রাসনির্ভর কূপমণ্ডূক জঙ্গিধারণায় পরিপূর্ণ। তাই এই ১১-১২ বছরের পর থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত সন্তানকে বুঝতে পারাটা খুব জরুরি।
মার্কিন গবেষক লরেন্সকোহলবার্গ পিয়াজের ধারণার জগৎ বা জ্ঞনীয় বিকাশের পর্যায়গুলোর সঙ্গে নৈতিক বিকাশের যোগসূত্রও তুলে ধরেন। মানুষের নৈতিকতার বিকাশের পর্যায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কোহলবার্গ তিনটি স্তরের বর্ণনা দেন। জন্ম থেকে প্রথম কয়েক বছর শাস্তি এড়াতে শিশুরা নিয়মকানুন মেনে চলে, এরপর বয়ঃসন্ধিতে সে নিজের কাজের স্বীকৃতির জন্য সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে একাত্ম হয়—‘ভালো ছেলে’ বা ‘ভালো মেয়ে’ অভিধায় তারা ভূষিত হতে চায়। আর নৈতিকতার বিকাশের তৃতীয় স্তর—যা শুরু হয় ১৬-১৭ বছর বয়সের দিকে। তখন সে নৈতিকতাকে নিজস্ব ধারণার জগতের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিতে থাকে। তার ধারণার জগৎ বা জ্ঞানীয় বিকাশ যদি হয় প্রচলিত সমাজ-সংস্কৃতিপন্থী, তবে তার নৈতিকতার চর্চা হয় সমাজ অনুগামী। আর তার ধারণার জগতে যদি সে বিশ্বাস করে এই সমাজ, এই প্রচলিত রীতিনীতি ‘সঠিক নয়’, তখন সে তার চারপাশকে পরিবর্তন করতে চায়। পরিবর্তনের পন্থা হতে পারে প্রচলিত পদ্ধতিতে অথবা তার নিজস্ব বিশ্বাসের মতো করে। এই পরিবর্তনের যেকোনো পথকে সে নিজস্ব যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে। একজন তরুণের মনোস্তত্ত্ব এখানেই জঙ্গিবাদে মোড় নেয়। প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে তার মধ্যে জন্ম নেয় উগ্রবাদ আর ভ্রান্ত বিশ্বাস। কিন্তু ওই যে তার ধারণার জগৎটিই পাল্টে গেছে, তাই সেই উগ্রবাদ আর নিষ্ঠুরতাকে সে ন্যায্য বলে মনে করে। নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা আর সন্ত্রাস তার কাছে নিজের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার এক ‘উপযুক্ত’ পদক্ষেপমাত্র।
বয়ঃসন্ধিকাল থেকে পরিণত বয়স, যেমন ২৫-২৬ বছর পর্যন্ত একজন তরুণের মনোজগতের এই পরিবর্তনটি আশপাশের সবাইকে বুঝতে হবে। এই বয়সে তার মনোজগতের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী—খেয়াল রাখতে হবে যে, এই পরিবর্তন যেন ইতিবাচক দিকে হয়—ধর্মান্ধতা বা জঙ্গিবাদের দিকে না হয়।
এ জন্য অভিভাবক, বিশেষ করে বাবা-মায়েদের যে বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে, তা হলো—
আচরণের পরিবর্তন
হঠাৎকরে আপনার সন্তানের আচরণের পরিবর্তন ঘটছে কি না, নজর রাখুন। যেমন সে হঠাৎ করে আগের বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে মিশছে না, খানিকটা একা হয়ে গেছে—নতুন নতুন বন্ধু তৈরি হয়েছে, কথাবার্তা কম বলছে, স্বভাবটি চাপা হয়ে গেছে, পুরোনো বইপত্র, গানের সরঞ্জাম ফেলে দিয়ে নতুন নতুন বইপত্র পড়া শুরু করেছে ইত্যাদি।
আচার-আচরণের পরিবর্তন
ধর্ম পালনের যে স্বাভাবিক ও প্রচলিত রীতি–নীতি রয়েছে, হঠাৎ করে আপনার সন্তান সেই রীতি–নীতি থেকে ভিন্ন রকম আচরণ করছে কি না খেয়াল করুন। দেখুন হঠাৎ করে আগের চেয়ে তার আচরণে বড় কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি না।
বাড়ির বাইরে রাত কাটানো
বেড়াতেযাওয়ার নামে বা বন্ধুর বাসায় থাকার নামে প্রায়ই বাসার বাইরে রাত কাটাচ্ছে কি না খেয়াল রাখুন, সত্যিই কোথায় রাত কাটায়, কী করে জানার চেষ্টা করুন।
ঘরে কী করছে
অনেকসময় ঘরে দরজা বন্ধ করে একাকী বা নির্ধারিত বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটালে তাদের নিরুৎসাহিত করুন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী করছে
আপনারসন্তান স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে, কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কি না, তার খোঁজখবর করুন।
কী ধরনের বই পড়ছে
পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সে কী ধরনের বই পড়ছে, সেগুলোর দিকে মনোযোগ দিন। তার ঘরে থাকা বইগুলো প্রয়োজনে আপনিও পড়ুন এবং সেখানে কোনো উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদের তথ্যসমৃদ্ধ বই আছে কি না, যাচাই করুন। সে কোন ধরনের সিনেমা দেখছে খেয়াল রাখুন, প্রয়োজনে তার সঙ্গে বসে সেই সিনেমা আপনিও দেখুন।
ইন্টারনেটে কী করে
সে ইন্টারনেটে কী করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বন্ধু কারা, সে কোন কোন গ্রুপ ফলো করে, তার মন্তব্যগুলো কী রকম, তা জানার চেষ্টা করুন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনিও তার বন্ধু থাকুন।
কথাবার্তা খেয়াল করুন
তার প্রতিটি কথাবার্তা এবং চারপাশে ঘটে যাওয়া বিষয়াদি নিয়ে তার মন্তব্যগুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিন। তার কোনো কথা বা মন্তব্যে আপনার যদি মনে হয় সেগুলো খুব বেশি র্যাডিকাল বা জঙ্গি ভাবাদর্শের প্রতি নমনীয়, তবে আপনার সন্তানকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখুন।
বিষণ্নতা আছে কি না দেখুন
কখনো বিষণ্নতা, হতাশা বা তীব্র অবসাদ তরুণদের এই ধরনের জঙ্গি হওয়ার অন্যতম ঝুঁকি হিসেবে কাজ করে। ফলে বিষণ্নতা বা হতাশার কোনো লক্ষণ আপনার সন্তানের মধ্যে আছে কি না, খেয়াল রাখুন।
মনে রাখবেন, আপনার সন্তান সে যত মেধাবীই হোক, যতই তথাকথিত আধুনিকমনস্ক হোক না কেন, সে ছেলে হোক বা মেয়ে, যে মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পড়ুক না কেন—জঙ্গিবাদের ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়। জঙ্গিবাদ এমনই এক দানব, যা গ্রাস করতে পারে আমাদের আগামী প্রজন্মকে—দুর্বল একটি রন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করতে পারে আপনার প্রিয়জনের অন্তঃকরণে। প্রতিরোধের সময় কিন্তু এখনই।
প্রতিরোধ যেভাবে
ইন্টারনেটের ব্যবহার সীমাবদ্ধ করুন
১৮ বছর বয়সের আগে একান্তে ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে সন্তানকে নিবৃত্ত করুন। বাড়িতে ডেস্কটপ কম্পিউটারটি প্রকাশ্য স্থানে রাখুন।
উৎসাহিত করবেন না
সন্তানের মধ্যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক আচরণ দেখলে সেগুলোকে কোনোভাবেই উৎসাহিত করবেন না। তার কোনো জঙ্গিভাবাপন্ন মন্তব্যকে হেসে উড়িয়ে দেবেন না।
পারিবারিকভাবে নৈতিকতা আর মুক্তচিন্তার চর্চা
পরিবারে প্রকৃত ধর্ম আর নৈতিকতার চর্চা করুন। পাশাপাশি শিশুকে পরমতসহিষ্ণুতা শেখান, মুক্ত চিন্তাকে উৎসাহিত করুন। পারিবারিক পরিমণ্ডলে কখনোই সাম্প্রদায়িক বা উসকানিমূলক মন্তব্য করবেন না। আপনার শিশুর ধারণার জগৎ তাতে বিকৃত হয়ে যাবে।
দেশীয় সংস্কৃতির চর্চায় উৎসাহ দিন
নিজস্বসংস্কৃতির চর্চায় শিশুকে উৎসাহিত করুন। নববর্ষ, জাতীয় দিবস ইত্যাদিতে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করুন। তার নাট্যচর্চা, নাচ, গানকে উৎসাহিত করুন। বাংলা গান, কবিতাকে ব্যঙ্গ করবেন না—ধর্মের নামে এই দেশীয় সংস্কৃতির চর্চাকে বাধা দেবেন না।
বই-সিনেমা বাছাই করে দিন
শিশুর মননশীলতা বিকাশে কার্যকর, মুক্তচিন্তার চর্চায় সহায়ক এমন ধরনের বই ও সিনেমা তাকে বাছাই করে দিন। তার মনটিকে জঙ্গিবাদের দিকে ধাবিত হওয়ার আগেই আপনি তাকে সুকুমারবৃত্তি আর খোলা হাওয়ার দিকে পরিচালিত করুন।
সন্তানের বন্ধু হোন
সন্তানের ওপর গোপন নজরদারি না করে তার বন্ধু হোন, তার ধর্মাচরণসহ নানা বিষয়ে তার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করুন। তার ভুলগুলো বুঝতে তাকে সাহায্য করুন। রাগ বা অভিমান করে নয়, তাকে ভালোবেসে সঠিক পথে নিয়ে আসুন।
আত্মতৃপ্তি নয়
‘আমার সন্তান নেশা করে না, প্রেম করে না—কেবল একটু বেশি বেশি ধর্মচর্চা করে’ এই ভেবে আত্মতৃপ্তি পাবেন না। মাদকের নেশা ছাড়াও তার মধ্যে জঙ্গিবাদের নেশা থাকতে পারে। বিষয়টি মাথায় রাখুন।
সন্তানের বন্ধুদের সম্পর্কে জানুন
কারা ওর বন্ধু, তা জানার চেষ্টা করুন। বন্ধুদের মধ্যে কোনো জঙ্গি আছে কি না, যাচাই করুন এবং প্রয়োজনে ওই ধরনের বন্ধুদের পরিহার করতে বলুন।
প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ
কখনো যদি মনে হয় আপনার সন্তান জঙ্গিবাদের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে, তবে প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক বা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে জানান। প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করুন। বিষণ্নতাসহ যেকোনো মানসিক সমস্যার চিকিৎসা প্রদান করুন।
গোপন করবেন না
আপনার সন্তানের মধ্যে জঙ্গি ভাবধারা দেখা গেলে বা সে জঙ্গিদলে যোগ দিয়েছে, এমনটা প্রমাণ পেলে বিষয়টি গোপন না করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোই সমীচীন। কারণ, এতে তার প্রাথমিক মৃদু শাস্তি হলেও অকালমৃত্যুর হাত থেকে সে রক্ষা পেতে পারে—বড় ধরনের শাস্তির হাত থেকে সে রেহাই পেতে পারে; পাশাপাশি রাষ্ট্র ও সমাজ রক্ষা পেতে পারে বড় ধরনের নাশকতার হাত থেকে।