জীবন যেমন

আনোয়ার কসাই

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

এলাকার দোকান থেকে মাংস কেনার কিছু সুবিধা আছে। যার একটা হলো, ঠকার আশঙ্কা কম থাকে। সে সুবিধা পেতেই কাঁটাবন ঢালের নতুন মাংসের দোকানটায় যাওয়া। দোকানির নাম আনোয়ার। এলাকার ভেতর সাধারণত দিনে দিনেই মাংস বিক্রি হয়ে যায়। এখন সন্ধ্যা সোয়া সাতটা। যথেষ্ট পরিমাণে মাংস আছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাম কত?’

আনোয়ার অবাঙালি। বললেন, ‘আপনের কাছ থিকা কি বেছি (বেশি) রাখুম? গরু পাচছ (পাঁচ শ), খাছি (খাসি) আটছ (টাকা প্রতি কেজি)।’

‘আমাকে দুই কেজি গরু দেবেন। তেহারি কাটিং করে দেবেন। “কোরোলি” এবং “ডকরের” মাংস থেকে মিলিয়ে দেবেন। চর্বি-হাড্ডি দেবেন না। (গরুর রানের ও বুকের বিশেষ অংশকে কোরোলি এবং ডকর বলা হয়)।’

 ‘আগের দিন নিছিলেন—খারাপ ছিল?’

 ‘খারাপ ছিল না। তা–ও বলে দিলাম। আপনারা তো এক–দুইবার ভালো দেন, তারপরে গোল দেওয়া শুরু করেন।’

আনোয়ার কসাই বললেন, ‘আমি তেহারির গোশতটা আগে বানাই, আপনে দেখেন।’

তিনি গরুর রানের ভেতর থেকে ‘কোরোলির গোশত’ বের করছেন। খুব সুন্দর করে মাংস কাটছেন। পর্দা ফেলে দিচ্ছেন। চর্বি ছাড়িয়ে নিচ্ছেন। বড় হাড্ডি দু-এক টুকরা দিতে গেলেই আমি বাধা দিচ্ছি। তিনি বাদ দিচ্ছেন। কাটা মাংস বোলের ওপর রাখছেন।

এর মধ্যে এক নারী ক্রেতা এলেন। পরনে নীল কামিজ, লাল পালাজ্জো। হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ। কপালে লাল টিপ। মাঝবয়স। আয়েশ করে বাজার করতে এসেছেন। দোকানের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গরুর গোশত কত করে কেজি?’

আনোয়ার কসাই চনমন করে তাকালেন। বললেন, ‘কয় কেজি লিবেন (নেবেন)?’

 ‘চার–পাঁচ কেজি নেব। আগে দাম বলেন।’

 ‘দাম তো সুবাই (সবাই) জানে, গরু ৫০০ ট্যাকা কেজি।’

 ‘বেশি চাচ্ছেন কেন? আপনি বিপুকে চিনেন?’

তিনি একটি বাড়ির নম্বর উল্লেখ করে বললেন, ‘বিপু থাকে সাততলায়। আমরা পাঁচতলায়। সম্পর্কে আমি বিপুর বোন। আমরা এখানকার বাড়িওয়ালা। ভাড়াটে না। আমরা প্রচুর মাংস কিনি। দাম ঠিক করে বলেন।’

 ‘আপনে যখন মহল্লার মানুছ (মানুষ) ৪৮০ টাকা কইরা দিয়েন।’

 ‘৪৮০ না ৪৫০ করে দিব। পাঁচ কেজি গোশত নেব। পারলে বলেন।’

আনোয়ার কসাই আমার তেহারির মাংস কাটা বন্ধ করে ধামাধাম ঝুলন্ত গোশতের খণ্ড নামিয়ে পটাপট কাটা শুরু করলেন। মনে মনে ভাবছি, আমার কাছে তিনি দাম বেশি নিচ্ছেন। ওনার কাছে কম। এটা তাঁকে বলব।

আনোয়ার কসাই দ্রুত হাতে বড় বড় টুকরা করছেন। বিরাট এক থোকা চর্বির টুকরা করার সময় আপা (ক্রেতা) কাতর গলায় বললেন, ‘ওইটা দিয়েন না প্লিজ! ওটা চর্বি। ওটা বাদ দেন।’

 ‘এইটা তাইলে কারে দিমু, গোশতর মধ্যে তো চর্বি থাকবেই। চর্বি ছাড়া গোশত হয় না।’

 ‘তা–ও এত বড়টা দিয়েন না।’

তিনি চর্বির অংশ ছোট করে মিশিয়ে দিলেন। এর মধ্যে কথার ফাঁকে বেশ কিছু বড় হাড়ও পিস করে মাংসের মধ্যে চালান দিয়েছেন। আমি দেখেছি। আপা তাকিয়ে দেখছেন, কিন্তু খেয়াল করতে পারছেন বলে মনে হয় না। ‘তিনি বিপুর বোন’, সম্ভবত এই বোধ থেকে নিশ্চিন্ত আছেন।

আনোয়ার কসাই গোশত মাপনিতে তুলতে তুলতে বললেন, ‘আমার ফোন নম্বর নিয়া রাখেন—যে সুমকা গোশত লাগব, খালি ফোন দিবেন। বাছায় দিয়া আছব। পয়ছা পরে দিবেন।’

আপা খুশি হলেন। আনোয়ার কসাই মাংস ব্যাগে তুলে এগিয়ে ধরে বললেন, ‘পাঁচ কেজি গোশতে দুই কেজি লস খাওয়াইলেন আমারে। ছকালে হইলে এইখানে ওজন হইতো ছাত (৭) কেজি। ছারা দিনে গোছত টাইনা ওজন কইমা যায়। লস।’

আপা এবার বিজয়ের অনুভবে আহলাদিত হলেন। বললেন, ‘আমরা তো জানি কখন কিনতে হয়...।’

তিনি মাংস রেখেই পাশের দোকানে গেলেন।

আমি আনোয়ারকে বললাম, ‘ওনাকে তো হাড্ডি–চর্বি মিশিয়ে দিলেন।’

‘না দিলে চলব ক্যামনে? আপনে সামনে না থাকলে নিচ থেকে আরও কিছু মিশাই দিতাম। আপনার জইন্য শরমে দিতে পারি নাই।’ বলেই তিনি খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমার তেহারির মাংস কাটা আবার শুরু করলেন।

‘আপনারা এই যে গোশতে ভেজাল করেন, এটা খুব ডেঞ্জারাস। এইটা ঠিক না।’

‘বাংলাদেছে ভেজাল কোন জাগায় নাই স্যার?’ দম নিয়ে আবার বলতে থাকেন, ‘আপনারে একটা বুদ্ধি শিখাই দেই। যেই কোনো কসাইয়ের দুয়ারে গিয়া কইবেন, তোমার ইমানের ওপর ছাড়লাম, ভালো গোশত দিয়ো। ভেজাল কইরো না। তাইলে ভালো জিনিস পাইবেন। গোশত কিনতে গিয়া বেশি পাহারা দিবেন, দামাদামি করবেন তো লস খাইবেন। আপনের এইখানে তবু হালকা–পাতলা ভেজাল আমি করছি, মিছা কথার কারবার আমরা করি না। কিন্তু যদি ফোন কইরা দেন, নিজে না আছেন। সলিড গোশত বাসায় পৌঁছাই দিব। কোনো ভেজাল থাকব না।’

আনোয়ার কসাইয়ের এ কথার কোনো জবাব হয় না। আমার তেহারির মাংস হাতে তুলে দিলেন। আমি নিয়ে চলে এলাম।