ফটোশুটের পর স্বামী অভিনেতা রহমত আলীর সঙ্গে খাবার টেবিলে ওয়াহিদা মল্লিক জলি।
ফটোশুটের পর স্বামী অভিনেতা রহমত আলীর সঙ্গে খাবার টেবিলে ওয়াহিদা মল্লিক জলি।

তারকা রেসিপি

আদর মেশানো ইলিশ রেসিপি

ইলিশ মাছের প্রতি কমবেশি ভালোবাসা সবারই আছে। পরিবার ভেদে ইলিশ মাছ রান্নার বেলাতেও আছে নানা ভিন্নতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অভিনেত্রী ওয়াহিদা মল্লিক জলি জানালেন এই রূপালি মাছ নিয়ে তাঁর জীবনের গল্প। সঙ্গে দিয়েছেন ইলিশ রান্নার রেসিপিও।

বাঙালির জীবন আর ‘ইলিশ’ সমান্তরাল। ‘ইলিশ মাছ খায় না, ইলিশ মাছ চেনে না এমন বাঙালি পাওয়া দুষ্কর। কবি–সাহিত্যিকেরাও তাঁদের লেখায় ইলিশ মাছের সমাদর করেছেন। বুদ্ধদেব বসু ইলিশ মাছকে ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ বলেছেন। হ‌ুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত চরিত্র মিসির আলী তো ইলিশ মাছ মরিচ–লবণ দিয়ে মেখে তার ওপর লেবু পাতলা গোল গোল করে কেটে রোদে দিয়ে বলেছিলেন, রান্না হয়ে যাবে। পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে নৌকার খোলে জমানো মৃত ইলিশের বর্ণনা পাওয়া যায়। সৈয়দ মুজতবা আলীও ছিলেন ইলিশপ্রেমী। মধ্যযুগের কবিরা ইলিশ রান্নার বিভিন্ন প্রণালির কথা বলেছেন।

বাংলা সাহিত্যে, বাঙালির হেঁশেলে, উনুনে ইলিশের অবাধ বিচরণ। ইলিশ মাছ এতই প্রিয় বাঙালির যে অনেককে বলতে শুনেছি ইলিশ মাছ আঁশ ছাড়িয়ে ধুয়ে কাটার পর নাকি আর ধুতে হয় না। তাতে নাকি ইলিশের গন্ধ চলে যায়। যেখানে মাছের গন্ধ তাড়ানোর জন্য বারবার মাছ ধুতে বলে, সেখানে ইলিশের গন্ধ ধরে রাখার কতই না প্রচেষ্টা।

আমার দাদির কাছে শুনেছি তাঁর ছোটবেলায় গ্রামে দেখেছেন, ইলিশ মাছ কাটার সময় বঁটির নিচে শাকসবজি কেটে ধুয়ে রাখা হতো। সেই শাকসবজিতে ইলিশের রক্ত টপ টপ করে পড়ত, সেটাই নাকি রান্না করা হতো। ইলিশ যে কতভাবে রান্না করা যায়, বলে শেষ করা যাবে না।

ইলিশ ভাজা, ইলিশের ঝোল, ইলিশ ভাপা, ইলিশ পাতুরি, ইলিশ পোলাও, ইলিশ কোর্মা, ইলিশ কাবাব, ইলিশের মাথা দিয়ে কচুশাক, মুগ ডাল দিয়ে মুড়িঘন্ট, নোনা ইলিশ—আরও কত কি।

ইলিশের নানা রকম রান্না করি আমি। তাই বলে কৃতিত্ব শুধু আমার একার নয়। আমি রান্না শিখি না, আমি গ্রহণ করি। যাঁরা আমাকে ভালোবাসেন, আমাকে খাইয়ে তৃপ্তি পান, আমার প্রতি টান, তাঁদের স্পর্শের রান্নাসহ সবটুকু গ্রহণ করি।

ইলিশ রান্না সমাচার লিখতে হলে আমার মা, শাশুড়ি–মা ছাড়াও আরও তিনজন নারীর কথা বলতে হয়, যাঁরা বর্ষীয়ান হয়ে মননে, চিন্তা-চেতনা-কর্মে আমার বন্ধুসম। মাতৃসম।

প্রথমে বলব শ্রদ্ধেয় অঞ্জলী বালার কথা। যিনি ফরিদপুরের শিশু–কিশোর সংগঠন ফুলকির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। স্বামী গৌরচন্দ্র বালা যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে খাদ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে রাজনীতি করে গেছেন। মাসিমা তাঁর রাজনৈতিক সহযোগী ‘ফুলকির মাসিমা’ নামে খ্যাত আমার মাসিমা অঞ্জলী বালা আমার বন্ধু বিশিষ্ট নাট্যজন বিপ্লব বালার মা। আমি ১৯৯৯ সালে ফরিদপুর গিয়েছি বিপ্লব বালা নির্মিত একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবিতে অভিনয় করতে। সেই প্রথম দেখা মাসিমার সঙ্গে। কী যে ভালোবাসতে পারেন মানুষকে, তাঁর প্রগতিশীল রাজনৈতিক মনন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে। নিজ হাতে রান্না করে পরিবেশন করাটা যেন তাঁর ভালোবাসার অভিব্যক্তি প্রকাশের পছন্দের ধরন। খেয়েছিলাম জিরা ফোড়ন, হলুদ, মরিচ আর নুন দিয়ে ইলিশ মাছের পাতলা ঝোল, ইলিশের মাথা মুগ ডাল দিয়ে মুড়িঘন্ট, ইলিশের মাথা ও কচুশাকের ঘন্ট জিরা ফোড়ন দিয়ে।

ধবধবে ফরসা মুখখানায় মিষ্টি এক টুকরো হাসি ঝুলে থাকে সব সময়। প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনায় সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক মানুষটির চোখ দুটো দিয়ে ঠিকরে পড়ে মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসা।

আমার স্মৃতিতে অম্লান এই আধুনিক মনস্ক মানুষটি। খাবার যখন ভালোবাসার বাহন হয়ে ওঠে, তখন সেই মানুষটিও তাঁর হাতের রান্না আমার মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। তেমনি আরেক বর্ষীয়ান নারী, যিনি আমার মস্তিষ্কে বসবাস করেন, তিনি হলেন শ্রদ্ধেয় দীপালি চক্রবর্তী। আমার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ১৯৯৪ সালে। আমার সহকর্মী সংগীত বিভাগের শিক্ষক গুণী সংগীতশিল্পী, তাত্ত্বিক স্বর্গীয় মৃদুলকান্তি চক্রবর্ত্তীর মা। মাসিমার অর্ধেক বয়স তখন আমার, কেমন করে যেন বন্ধু হয়ে গেলাম। এই অসমবন্ধুত্বে অনর্গল কথা বলায় ক্লান্তি আসেনি কখনো। তিনি সেতার শিখেছিলেন। স্কুলজীবনে বিয়ে হলেও পরে বিএ পাস করেছিলেন। প্রথম জীবনে কমিউনিস্ট পার্টি, পরে আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। জড়িত ছিলেন উদীচী মহিলা পরিষদের সঙ্গে। সর্বোপরি একজন মুক্তিযোদ্ধা তিনি।

কী প্রখর জীবনবোধ। সিলেট থেকে ঢাকায় এলেই ছুটে আসতেন আমার কাছে। না হলে ডেকে পাঠাতেন। মজার মজার রান্না করে খাওয়াতেন আর কীভাবে রান্না করেছেন, তা বলতেন। কারণ, জানতেন আমি নিত্যনতুন রান্না করতে ভালোবাসি। তাঁর হাতের ইলিশ পাতুরি অসাধারণ। এখনো ইলিশ পাতুরি রান্নার সময় তিনি আমার পাশে বসে মিটিমিটি হাসতেন। কেন? আমি তাঁর রেসিপি মাঝে মাঝে একটু বদলে দিই। এটা আমার স্বভাব।

দীপালি চক্রবর্তী ইহলোকে নেই। সবশেষে বলব সেই মানুষের কথা। যাঁর ভালোবাসা ও হাতের রান্নার আকর্ষণে বারবার কলকাতা ছুটে যেতাম। আমাদের প্রাণের মামিমা, মা। কিছুদিন আগে করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমি আর আমার বর রহমত আলী কলকাতায় নাটক নিয়ে পড়তে গেলাম ১৯৮৫ সালে, তখনই প্রথম দেখা আমাদের।

কলকাতার বিশিষ্ট অভিনেতা পার্থসারথী দেব, যিনি আমার ‘রাখি পরানো দাদা’। সেই দাদার মা শ্রদ্ধেয় রত্না দেব। ময়মনসিংহে জন্ম, বেড়ে ওঠা, স্কুল, শ্বশুরবাড়ি সারা জীবন ময়মনসিংহের ভাষায় কথা বলেছেন। বাংলাদেশ বলতে অজ্ঞান, বাংলাদেশের মুগ ডাল, শাকপাতা থেকে ইলিশ মাছ, মানুষ—সব ভালো তাঁর কাছে। রোববার ছুটির দিনে ছুটে যেতাম মাসিমার কোলে মাথা রেখে গল্প করতে। বিভিন্ন পদের রান্না করতেন আমাদের জন্য। পরম মমতায় ভালোবেসে মায়ের মতো করে খাওয়াতেন।

অদ্ভুত এক স্নেহময়ী মা। বাংলাদেশে ফিরে আসার পর যখন কলকাতা যেতাম, রোজার সময় হলে ভোর রাতে উঠে সাহ্‌রি ও সন্ধ্যায় ইফতারির আয়োজন করতেন যত্নের সঙ্গে, বিশ্বাসের সঙ্গে।

নিয়মিত পূজা অর্চনা করতেন, কিন্তু কোনো জাতপাত মানতেন না। একই থালায় ভাত মাখিয়ে নিজে খেতেন, আবার আমাকে খাইয়ে দিতেন। আমার রান্না খুব পছন্দ করতেন। আমি গেলেই রান্নাঘর থেকে বের হয়ে যেতেন। বলতেন, ‘তুমি রান্না করো মা, কত দিন তোমার রান্না খাইনি।’ মাসিমার হাতে লুচি, আলুর দম, সুক্তো, কলার মোচার ঘন্ট, টমেটোর চাটনি তো অমৃতসমান। তবে ভাপা ইলিশ তাঁর হাতেরটা তাঁরই মতো। স্নেহ আর ভালোবাসা এক চিমটি যোগ হতোই।

আমাকে প্রথম আলোর নকশা ভাপা ইলিশ আর ইলিশ পোলাও রান্না করতে রেসিপি লিখতে বলেছে। আমার তো নিজস্ব কোনো রেসিপি নেই। ভালোবাসার মানুষদের হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসার উত্তাপে এক চিমটি স্মৃতি, এক চিমটি ‘মন কেমন করা’, এক চিমটি আদর মিশিয়ে আমার রান্না, আমার রেসিপি। তাই হয়তো সব সময় রান্না এক রকম হয় না। রেসিপিও এক থাকে না। একই পদ হরেক রকমভাবে রান্না করি আমি।

ইলিশ পোলাও

উপকরণ: ইলিশ মাছ ৬ টুকরা, পেঁয়াজকুচি আধা কাপ, পেঁয়াজবাটা ৩ টেবিল চামচ, আদাবাটা দেড় টেবিল চামচ, রসুনবাটা ১ টেবিল চামচ, মরিচগুঁড়া ১ চা-চামচ, তেল দেড় কাপ, ঘি সিকি কাপ, লাল ও সবুজ কাঁচা মরিচ ১০-১২টি, টক-মিষ্টি দই আধা কাপ, নারকেল দুধ ১ কাপ, চাল আধা কেজি, পেঁয়াজ ভাজা ও বেরেস্তা আধা কাপ এবং লবণ পরিমাণমতো।

প্রণালি: প্রথমে ইলিশ মাছটি রান্না করে নিতে হবে। দই ভালো করে ফেটিয়ে নিতে হবে। এবার দইয়ে পেঁয়াজবাটা, রসুনবাটা, মরিচের গুঁড়া, পরিমাণমতো লবণ ও আধা কাপ নারকেল দুধ ভালো করে মিশিয়ে এর মধ্যে মাছ দিয়ে ম্যারিনেট করে ৩০ মিনিট রেখে দিন। ৩০ মিনিট পর কড়াইয়ে উপকরণের অর্ধেক তেল ও অর্ধেক ঘি দিয়ে আস্তে করে ম্যারিনেট করা মাছগুলো ছেড়ে দিতে হবে। দু–তিন মিনিট পর খুব সাবধানে মাছগুলো উল্টিয়ে দিন। এরপর সবুজ ও লাল মরিচ ওপরে ছড়িয়ে দিয়ে পাত্রটি ঢেকে দিতে হবে।

মাঝারি জ্বালে ৬ মিনিট রাখার পর চুলা বন্ধ করুন। আরেকটি পাত্রে বাকি তেল ও ঘি দিয়ে অবশিষ্ট পেঁয়াজকুচি দিয়ে দিন। পেঁয়াজ হালকা লাল হলেই চাল দিয়ে দিন এবং ভালোভাবে চালটা ভেজে ভেজে নিন। আধা কেজি বা দুই পট চালের জন্য চার পট পানি লাগবে। পৌনে তিন পট পানি ও আধা কাপ নারকেল দুধ চালে দিয়ে দিন। চালে বলক এলে ৬-৭টি সবুজ ও লাল মরিচ দিয়ে দিন। এরপর পাত্রটি ঢেকে দিন, জ্বাল কমিয়ে ২০ মিনিট চুলায় রেখে দিন। ২০ মিনিট পর পোলাও হয়ে গেলে এর ওপর রান্না করা ইলিশ মাছগুলো এমনভাবে সাজিয়ে দিন যেন ভাতের মধ্যে ডুবে থাকে। মাছের ঘন ঝোল পোলাওয়ের ওপর ছড়িয়ে দিন। সবশেষে বেরেস্তা ছিটিয়ে ১০ মিনিট দমে রাখুন।

এবার একটি ছড়ানো পাত্রে খুব সাবধানে প্রথমে পোলাও, পরে মাছগুলো সাজিয়ে পরিবেশন করুন।

ভাপা ইলিশ

উপকরণ: ইলিশ মাছ বড় ৪ টুকরা, সাদা শর্ষেবাটা ৪ টেবিল চামচ, পোস্তাবাটা ২ টেবিল চামচ, নারকেল দুধ আধা চামচ, কাঁচা মরিচবাটা ১ টেবিল চামচ, লাল গোটা কাঁচা মরিচ ৮টি, লবণ পরিমাণমতো, চিনি আধা চা-চামচ, হলুদ আধা চা-চামচ ও শর্ষের তেল ৮ টেবিল চামচ।

প্রণালি: ইলিশ মাছের টুকরা সব উপকরণ দিয়ে মাখিয়ে আধা ঘণ্টা রেখে দিতে হবে। তারপর একটি টিফিন বাটিতে মসলাসহ মাছগুলো সাজিয়ে দিন। বাটির মুখ বন্ধ করে পানির মধ্যে এমনভাবে দিতে হবে যে বাটির মধ্যে পানি না ঢুকে যায়। তারপর পানির পাত্রটি মাঝারি জ্বালে চুলায় রাখবেন ৩০ মিনিট। এরপর চুলা বন্ধ করে টিফিন বাটিটি পানির পাত্র থেকে নামিয়ে খুব সাবধানে পরিবেশন পাত্রে সাজাবেন, যাতে মাছ না ভেঙে যায়।