খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাগ ১৮ রিলোডেড

আতশবাজির আকাশ

বাসে চড়ে উৎসবের জানান দিতে খুলনা শহরে বেরিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: পার্পল বার্ড
বাসে চড়ে উৎসবের জানান দিতে খুলনা শহরে বেরিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। ছবি: পার্পল বার্ড

হঠাৎই খুলনার শিববাড়ি মোড়ের দখল নিয়ে নিল একদল তরুণ–তরুণী। গানের তালে শুরু হলো নাচ। মিনিট পাঁচেকের আয়োজন। আশপাশে ভিড় জমানো দর্শক কিছু বুঝে ওঠার আগেই তরুণ–তরুণীর দল আবার মিশে গেল পথচারীদের সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল ট্রাকে চড়ে হইহুল্লোড় করতে করতে তরুণেরা চক্কর দিচ্ছেন খুলনা শহর, এক উৎসবের জানান দিতে। ফ্ল্যাশ মব ও রোড শোর মধ্য দিয়ে এভাবেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) ছাত্রছাত্রীরা জানিয়ে দেন ক্যাম্পাসের প্রাণের উৎসব র‍্যাগ ডের আগমনী বার্তা।

 ‘প্রত্যাশী প্রাণে মোরা ঋদ্ধ বন্ধনে’ স্লোগানে ৩ অক্টোবর থেকে শুরু হয় খুবির ১৫ ব্যাচের সব বিভাগকে নিয়ে তিন দিনব্যাপী র‍্যাগ ডে বা শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠান ‘র‍্যাগ ১৮ রিলোডেড’। এ বছরের দ্বিতীয় র‍্যাগ ডে এটি। কিন্তু সাত মাসের ব্যবধানেই আবার র‍্যাগ ডে হওয়ায় উৎসব কি এর আবেদন হারাল? একেবারেই না!

আয়োজনে কোনো কমতি না রাখতে ১৫ ব্যাচের সে কী ব্যস্ততা! এত কাজ করতে গেলে ক্লাস টেস্ট, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন, উপস্থিতিতে তার প্রভাব পড়বে না? কিন্তু চার বছরে তো এগুলো অনেক জমানো হয়েছে, বিদায় তো আর বারবার হবে না! তাই সিজিপিএর কথা না ভেবে, অর্থ ব্যবস্থাপনা, টি–শার্ট, কালার ফেস্ট, আনুষ্ঠানিক আয়োজন, প্রচারণা ছাড়াও আরও অনেক কমিটি গঠন করে সবাই যাঁর যাঁর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। কাউন্টডাউনে যখন দিন বাকি ১, তখনই পুরা ক্যাম্পাসে উৎসব শুরু হয়ে গেছে। চারদিক উদ্ভাসিত রঙিন আলোয়৷ ছোট ছোট বোতলের ভেতর আলো জ্বালিয়ে সাজানো হয়েছিল মূল ফটকের সামনের রাস্তাটি, যেন ক্যাম্পাসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিগুলোকে বোতলবন্দী করে সবকিছু রাঙানোর চেষ্টা। দিন শেষে বিদায়ী ব্যাচের সঙ্গে শেষবারের মতো ছোট ভাইবোনেরা আনন্দ, হাসি, ঠাট্টায় মেতে ওঠেন সেই রাতে।

বিদায়ের কান্না

৩ অক্টোবর সকালে ক্যাম্পাসে দেখা গেল দাঁড়িয়ে আছে ২৬টি ট্রাক ও নয়টি বাস। শিক্ষার্থীরাও সবাই চলে এসেছেন রঙিন সাজে। বিদায়ী ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নিজেদের উপস্থিতি আলাদাভাবে জানান দিতে ছাত্রীরা পরেছিলেন গোলাপি রঙের শাড়ি আর ছাত্ররা পরেছিলেন টি–শার্ট। বেলা ১১টায় প্রধান অতিথি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাধন রঞ্জন ঘোষ বেলুন উড়িয়ে উৎসবের উদ্বোধন করেন। এরপরই পুরো শহর ঘুরে উৎসবের সূচনার কথা জানিয়ে দিতে শিক্ষার্থীরা উঠে পড়েন বাস ও ট্রাকে। শহর ঘুরে বাস-ট্রাকগুলো ক্যাম্পাসে ঢুকতেই শুরু হয়ে গেল রঙের উৎসব। আবির–কাদা মেখে যাচ্ছেতাই চেহারা হলো একেকজনের! তবে চেহারা চিনতে ভুল হলেও নাচতে কারও ভুল হলো না! দুপুর পর্যন্ত সবাই মেতে ছিলেন এই রঙের খেলায়। সেদিন বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হলো সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা।

পরদিন সকাল ১০টায় লিয়াকত আলী মিলনায়তনে হয় ১৫ ব্যাচের আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান। এরপর বিকেল চারটায় মুক্তমঞ্চে শুরু হয় ১৫ ব্যাচ আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শেষবারের মতো প্রাণের ক্যাম্পাসে নাচ, গান ও কবিতা পরিবেশন করে রাঙিয়ে তুলেছিলেন তাঁরা।

কনসার্টে শিক্ষার্থীদের উচ্ছাস

৫ অক্টোবর ছিল কাঙ্ক্ষিত কনসার্টের রাত। ক্যাম্পাসে হাজির দেশের জনপ্রিয় তিন ব্যান্ড—শিরোনামহীন, আর্বোভাইরাস ও এলআরবি। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই তো বটেই, পুরো খুলনা শহরের মানুষই জড়ো হয়েছিল ক্যাম্পাসে। শিরোনামহীন ‘ক্যাফেটেরিয়া’ গান দিয়ে শুরুতেই বিদায়ী ব্যাচকে এই আনন্দের মধ্যেও স্মৃতিকাতর করে তুলল। এরপর তিন ব্যান্ড চার ঘণ্টার মতো সবাইকে মাতিয়ে রাখলেও কনসার্টের শেষ ভাগে পরিবেশ থমথমে হয়ে যায়। কান্নার শব্দকে চাপা দেওয়ার জন্যই মনে হলো আকাশে আতশবাজির হাট বসানো হয়েছে। আনন্দ আর বিষাদের এক অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটল সবার চোখেমুখে।

এই উৎসব সম্পর্কে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মেহজাবীন হোসেন বলেন, ‘আমাদের র‍্যাগ ডে তো খুলনা শহরেরই একটা বড় উৎসব। তাই আলাদা করে বলার কিছু নেই। জুনিয়র–সিনিয়রদের নিয়ে প্রতিবারের মতো এবারও ভরপুর আনন্দ করেছি।’ ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রুবাইয়াৎ (কাব্য) জানান, নিজের র‍্যাগ ডে হওয়ায় অনুভূতি ছিল দুঃখ-হাসির মিশেল। একদিকে দিন–রাত কাজ করে সব ব্যবস্থা করা, উৎসবের আমেজ, অন্যদিকে ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার চাপা একটা কষ্ট ও শূন্যতা।’