>কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এবার কি সেটা হবে? সবাই কি যাবেন বায়তুল মোকাররম বা নিউমার্কেটে। করোনা এই সব ব্যবসায়ীর জীবনকেও দুর্বিষহ করে তুলেছে।
‘আমি একাই রওনা হয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল না কোনো কাফেলা, না সঙ্গীসাথি। কিন্তু একটা আহ্বান আমাকে পেয়ে বসেছিল। আমি পৌঁছাতে চেয়েছিলাম আমার দীর্ঘ লালিত গন্তব্য মক্কা ও মদিনায়।’
জুন ১৩২৫। ২১ বছরের এক উদ্ভিন্ন যুবক বেরিয়ে পড়েন পৃথিবীর পথে। ৩০ বছর ঘোরেন ‘দেশে দেশে মোর দেশ আছে’ ভাবনায়। বাড়ি ছাড়ার সময় তাঁর কাছে ছিল যৎসামান্য অর্থ ও একটি জায়নামাজ। এই যুবক আর কেউ নন, বরং বিশ্ববিশ্রুত পর্যটক ইবনে বতুতা।
এ গল্প তাঁকে নিয়ে নয়, বরং জায়নামাজ নিয়ে। সামনে ঈদুল ফিতর। বাঙালির ক্রয়তালিকায় অবশ্যই এটা থাকে, পরিবারে ব্যবহার কিংবা মুরব্বিদের উপহার দেওয়ার জন্য।
জায় মানে মাটি বা জমি। আর নামাজ। শব্দ দুটোই ফারসি। এই উপমহাদেশে ফারসি ভাষার প্রভাব অনেক বেশি। একসময় রাজভাষাও ছিল। তাই আজও আমাদের কাছে খোদা আর পয়গম্বর, নামাজ ও রোজা অনেক প্রিয় এর অন্য প্রতিশব্দের চেয়ে।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) জায়নামাজে নামাজ পড়তেন। সেই জায়নামাজকে বলা হতো খুমরাহ। খেজুরগাছের আঁশ থেকে এই জায়নামাজ তৈরি হতো। আরবরা এখন যেগুলো ব্যবহার করে, সেগুলো সাজ্জাদা বা মুসল্লা নামে পরিচিত।
বিভিন্ন সময়ে রাজা-বাদশাহরা রাজশিল্পীদের দিয়ে জায়নামাজের নকশা করিয়েছেন। শ্রেষ্ঠ বয়নশিল্পীরা সেসব বুনেছেন। আর সেই অনিন্দ্য জায়নামাজে নামাজ পড়েছেন তাঁরা। আবার অনেক সময় এই জায়নামাজ হয়েছে শিল্পীর ক্যানভাস। পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ইতালির রেনেসাঁ শিল্পী জিওভান্নি বেল্লিনি, ভিত্তোরে কারপাচ্চিও এবং লোরেঞ্জো লোত্তো তুরস্কের জায়নামাজকে তাঁদের ক্যানভাস করেন।
ইরানে সেই চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই দারুণ সব জায়নামাজ তৈরি হয়েছে। পারস্যের গালিচাশিল্পীরা বুনেছেন নানা ধরনের জায়নামাজ। লক্ষণীয় হলো, জায়নামাজের নকশায় মিহরাবের উপস্থিতি। নানাভাবে ঘুরেফিরে এই মিহরাব এসেছে জায়নামাজে। দেশে দেশে এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এমনকি এখন চৈনিকরা যে কারখানাভিত্তিক উৎপাদন করছে, সেখানেও নকশায় মিহরাবের উপস্থিতি থাকছে।
জায়নামাজ বিভিন্ন ধরনের, নকশার আর মানের হয়ে থাকে। ব্যবহার করা হয়ে থাকে নানা ধরনের উপাদান। এখনো যেমন হাতে বোনা হয়, তেমনি কারখানায়ও তৈরি হয়ে থাকে। এর আকার-আকৃতিতেও মেলে রকমফের। সাধারণভাবে এর মাপ হলো আড়াই ফুট চওড়া ও চার ফুট লম্বা। আসলে একজন মানুষ হাঁটু গেড়ে বসতে যেটুকু পরিসরের প্রয়োজন হয়, সেটাই জায়নামাজের মাপ।
আমাদের দেশেও পাওয়া যায় দেশি ও বিদেশি জায়নামাজ। একসময় ছোট ছোট মাদুর তৈরি করা হতো নামাজের জন্য। এখন সেসব প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তার জায়গা নিয়েছে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা জায়নামাজ।
যেকোনো দেশের পোশাক-আশাক আর আহারে থাকে সেখানকার জলবায়ু ও সংস্কৃতির প্রভাব। পৃথিবীর বহু দেশে ধর্মীয় কারণে টুপি পরার চল রয়েছে। আরব দেশে দিনে গরম, রাতে ঠান্ডার কারণে মাথা ঢাকার চল ছিল। এখনো আছে। তারা একসময় টুপিকে কালানসুয়া বলত। তবে এখন বলে তাকিয়া।
টুপি সুফিদের কাছ থেকে বাঙালির অনুষঙ্গ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এখানে টুপি নিয়ে আছে নানা মতবাদ। এর ওপর ভিত্তি করে হয়েছে নানা নকশা। আবার দেশভেদেও রয়েছে তারতম্য। পারস্যের উষ্ণীষের বয়স তো ছয় হাজার বছর পেরিয়েছে। রোমানরাও টুপি পরেছে। চীনে এই প্রথা বহু বছরের পুরোনো। আফ্রিকার দেশে দেশে আছে টুপি। এটা তাদের জাতীয় পোশাকের অংশ।
সংস্কৃতি, রাজনীতি আর ধর্ম—তিন ক্ষেত্রেই রয়েছে টুপির ব্যবহার। নানা অনুঘটক টুপির নকশাকে প্রভাবিত করেছে। মুসলমানদের কাছে টুপির রয়েছে আলাদা কদর। আর ঈদ এলে তো কথা নেই। নতুন টুপি কিনতেই হবে।
সভ্যতার উন্মেষ আর ক্রমবিস্তার অনুঘটক হয়েছে মানুষের ভাবনা ও রুচি বদলে। অসন-বসন থেকে সুগন্ধি তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পবিত্রতা আর ফুল্লতার আকাঙ্ক্ষা। লাতিন শব্দ পেরফুমারের মানেটাও তা–ই: ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে। সুগন্ধি অবশ্য আরও একটা কাজ করেছে, পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করা। এর উদ্ভাবন কোথায়, তা নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। মিসর, মেসোপটেমিয়া, চীন নাকি সাইপ্রাস! আবার ভারতকেও হেলা করা সম্ভব নয়। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোয় সুগন্ধির অস্তিত্ব মেলে। চরক আর সুশ্রুত সংহিতায়ও এর উল্লেখ আছে। বাকি ইতিহাসের সৌরভ না ছড়িয়ে বরং সোজাসুজি চলে আসা যাক আবরদের তল্লাটে। আরবরা এই সুগন্ধিকে তাদের ভাষায় বলে আতর।