৭ সেপ্টেম্বর ইউএস ওপেনের শিরোপা জিতে ১৮তম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয় করেন টেনিস তারকা সেরেনা উইলিয়ামস। তাঁর জন্ম ১৯৮১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে। বর্তমানে তিনি নারী টেনিস খেলোয়াড়দের মধ্যে র্যাংকিংয়ে প্রথম।
অনেকেই বলে আমি সুপারস্টার, সব সময় জয়ই যেন আমার লক্ষ্য। কিন্তু আসলে আমি নিতান্তই এক সাধারণ মানুষ। মহামানবী নই। একজন খেলোয়াড়মাত্র, টেনিস খেলেই দিন কাটে আমার। অন্যদের মতো আমিও কথা বলি, হাসি, চিন্তা করি। কেউ কেউ বাড়িয়ে কিংবদন্তিতুল্য অনেক টেনিস খেলোয়াড়ের সঙ্গে আমার তুলনা করেন। কিংবদন্তি? আমি জানি না, আমি শুধুই সেরেনা।
টেনিস কোর্টে আসলে আমি একজন অভিনয়শিল্পীমাত্র। সেখানে রাগ, অভিমান, হাসিকান্না দেখানো বিলাসিতা। দৌড়ে দৌড়ে টেনিস বলে আঘাতের পর আঘাত করতে করতে আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। প্রতিযোগিতায় সেরা হয়ে পদক হাতে তুলে আমি অভিনয়-দক্ষতা দেখাই। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়াটাই আসলে যেকোনো কাজের সাফল্য কিংবা পরিশ্রমের মূল সূত্র। মুখে হাসি রেখে কাজ করে যান, সাফল্য দরজার বাইরে আপনার জন্য অপেক্ষা করবে।
পথে নামলে অন্য মানুষের সমালোচনা আসবেই। তাই বলে থেমে থাকা বোকামি। নিজের কাছে সৎ থাকাটাই সবচেয়ে বড় শক্তি তখন। সমালোচনা আসবে আবার ফিরে যাবে, কিন্তু বিভ্রান্ত হওয়া চলবে না। সাফল্য আসবে কি না তা নিয়ে হতাশ হবেন না। নিজের পথে হেঁটে চলাই তো আনন্দের, গর্বের।
আমার শৈশবটা ছিল দারুণ। বোন ভেনাসের সঙ্গে খেলতে পারাই ছিল আমার ভীষণ আনন্দের। খেলায় আমি থাকতাম রাজকন্যা আর ভেনাস ছিল জাদুকর। আমাদের বেড়ে ওঠা ছিল ক্যালিফোর্নিয়া আর ফ্লোরিডা শহরে। বাবা-মা আর বোনদের নিয়েই ছিল আমার রঙিন ছোটবেলা। সেই সব দিনের কথা ভাবলে আবার ছোট হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। টেনিসের সঙ্গে সঙ্গে তখন জিমন্যাস্টিক্স আর ব্যালেতেও আমার আগ্রহ ছিল। আমি সব সময় ভেনাসকে অনুসরণ করতাম। ভেনাস যদি গণিতবিদ হতো তাহলে আমিও সম্ভবত তা-ই হতাম।
আমি পড়াশোনায়ও বোনকে অনুসরণ করতাম। আমার বাবার জন্যই আজ আমরা এখানে। একজন মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় তার পরিবার। পরিবারের কারণেই মানুষ সামান্য থেকে অসামান্য হয়ে ওঠে। আমার বাবার কথা ভাবলে আমারই হিংসা লাগে। তিনি এমনই এক বাবা, যাঁর দুই মেয়েই যখন উম্বলডনের ফাইনালে খেলে আর তিনি কাউকেই সমর্থন করতে পারেন না। এটা তাঁর জন্য যতটা হতাশার, তারচেয়ে বেশি আনন্দের ঘটনা নিশ্চয়ই।
আমার বয়স যখন ১৭ তখন বাবা-মায়ের পরামর্শ ছিল ‘খুশি থাকো, নিজের মতো চলো’। এখনো সেই কথা মনে রেখেছি এবং সেভাবেই চলার চেষ্টা করি। নিজের মতো চলা আর নিজেকে খুশি রাখাই মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জকে জয় করার নামই জীবন! সফল হবেন কি না তার উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ কিন্তু তার আগে মাঠে নামতেই হবে। চ্যালেঞ্জ নিতে হবে নিজেকেই। কাউকে প্রতিপক্ষ ভেবে নয়, নিজের সঙ্গে নিজের চ্যালেঞ্জ নিতে হয়।
আমি অনেক ছোটবেলা থেকে টেনিস খেলা শুরু করি। কখনোই মনে হয় না টেনিসই হবে আমার সব। ১৭ বছর বয়সে আমি যখন প্রথম কোনো প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করি, তখনই আমার ভাগ্য আর লক্ষ্য বদলে যায়। তার আগে পর্যন্ত আমার বিশ্বাস হতো না আমি পারব। কিন্তু মাঠে নামার পরেই সব বদলে গেছে। এর পরের গল্পটা সবার জানা। সেই ১৭ বছরের সেরেনা এখন টেনিস খেলতে পারে।
কিশোর বয়স থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলাম ফ্রেঞ্চ ওপেন টেনিস প্রতিযোগিতায় আমি আর আমার বোন বিজয়ী হলে ফরাসি ভাষায় কথা বলব। তখন ফরাসি শিখেছিলাম, এখন নিয়মিত ফরাসি বলতে হয় আমাকে। লক্ষ্য ঠিক রাখলে কোনো স্বপ্নই বৃথা যায় না।
আমার বাবার কথা ছিল, ‘তুমি যদি পরাজয়ের কথা ভাব, তাহলে পরাজয় আসন্ন’। এটা কিন্তু সত্যি। আপনি যা ভাববেন তা-ই আপনাকে পৃথিবী দেবে। নিজেকে সাধারণের মধ্যে অনন্য করে তুলতে চাইলে আপনার পরিশ্রমের বিকল্প নেই। ঘাম ঝরালেই আপনার নাম পৃথিবী মনে রাখবে।
ক্যারিয়ারে উত্থান-পতন থাকবেই। জয়ের স্বাদ আসলে মিষ্টি। কিন্তু জয়কে ধরে রাখাই টক! আমি সাফল্য পেলেও খারাপ সময়গুলোর কথা ভুলে যাই না। আমি প্রশংসার জোয়ারে গা ভাসাই না। সেরা হওয়ার জন্য মাঠে নামি আমি। কোনো প্রতিযোগিতায় সেরা হওয়া কিন্তু সহজ কোনো কাজ নয়। তার ওপর যদি প্রতিপক্ষের কেউ নিজের বোন হয়। কিন্তু তার পরেও আমি লড়তে মাঠে নামি। লড়াই করার মানসিকতা জীবনকে অনেক দূর নিয়ে যায়।
জীবনের লক্ষ্য একবার ঠিক করে ফেললে তাকে অনুসরণ করতেই হবে। কিশোর বয়সে পাহাড় ডিঙানোর স্বপ্ন দেখলে বৃদ্ধ হলেও সেই স্বপ্ন দেখার শক্তি নিজের মধ্যে রাখতে হবে। আর তাতেই জীবন উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
সিএনএন–এর ২০১২ সালের ২৫ নভেম্বরের সাক্ষাৎকার অবলম্বনে লিখেছেন জাহিদ হোসাইন খান।