আজ জুন মাসের তৃতীয় রোববার, বাবা দিবস। বিশেষ এই দিন উপলক্ষে পাঠকের কাছে লেখা আহ্বান করেছিল গোদরেজ প্রটেক্ট ম্যাজিক হ্যান্ডওয়াশ ও প্রথম আলো অনলাইন। ‘বাবা, তোমাকে বলা হয়নি’ শিরোনামে বিপুলসংখ্যক পাঠক লিখেছেন তাঁদের মনের কথা। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি প্রকাশিত হলো এখানে।
বাবারা ঠিক কেমন হয়, কোথায় এত ভালোবাসা জমানো থাকে, আপনাকে বাবা হিসেবে না পেলে কোনো দিন জানা হতো না! আশপাশে কত শত বাবা দেখি, অথচ আপনি নিতান্ত সাধারণ, তবু কী অসাধারণ বাবা! কোনো দিন সন্তানের আতঙ্কের কারণ হননি, কখনো অপমান-অপদস্থ বা শাসনে-দুঃশাসনে নাজেহাল করেননি। আপনি বাসায় না থাকলে রাতে ঘুমাতে পারতাম না, জানতেন। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম, খুব কষ্ট হলেও আপনি অন্য কোথাও থাকতেন না। রাতে একা টয়লেটে যেতেও ভয়, আম্মাকে ডাকতাম। আপনি লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলে ঘুম জড়ানো চোখে দাঁড়িয়ে থাকতেন। কত রাত ঘুম ভাঙিয়েছি, কোনো দিন বিরক্ত হয়েছেন বলে মনে পড়ে না!
আপনার সঙ্গে আমার একটা ভালো ছবিও নেই। তবু চোখ বুজলেই স্পষ্ট দেখতে পাই, আম্মার দেওয়া গরম ভাত, নাকেমুখে গুঁজে ছুটছেন সাত-আট মাইল দূরের স্কুলে। আপনার সাইকেলটা খুব আলাদা ছিল। ওতে দুটা চাকা ছাড়া কিচ্ছু ছিল না। না ছিল হুইল কাভার, অথবা ভালো সিট। সেই সিটে বসেই পেরিয়ে যেতেন মাঠ, ঘাট, সরু কাদামাটির পিচ্ছিল পথ। না, সাইকেলে ব্রেকও হতো না। আপনি পা বাড়িয়ে সাইকেলের গতি কমাতেন। স্কুলে যাওয়ার লাল মাটির পথ ছিল পুরোটা কাঁচা। বর্ষায় আঠালো আর পিচ্ছিল ও পথ শুধু আপনি ছাড়া আর কারও পক্ষে পাড়ি দেওয়া বোধ হয় সম্ভব ছিল না! একহাঁটু কাদা নিয়ে বাড়ি ফিরতেন।
ভরা বর্ষায় পথ ডুবে যেত। কখনো কোমর, কখনো বুকসমান পানি পার হতেন। কত দিন ভাঙা সাইকেল মেরামতে হাত লাগিয়েছি; কাদায় সয়লাব চাকা ধোয়া-মোছা, কেরোসিন দেওয়া, কখনো টায়ার-টিউব পরিবর্তন, জোড়াতালি দেওয়া…। আমারও খুব ইচ্ছা হতো...ইশ, আমিও যদি সাইকেলে ছুটতে পারতাম পঙ্খিরাজের মতো!
আমি নব্বই দশকের কথা বলছি। তখন আমাদের এলাকার রাস্তায় কোনো মেয়ে সাইকেল চালাত না বা কাউকে দেখিনি সাইকেল চালাতে পারে। ব্যতিক্রম কেবল কজন এনজিও কর্মী। আপনি সাইকেল সারাইয়ের দোকান থেকে ছোটদের সাইকেল ভাড়ায় আনলেন, ভাবলেই কেমন অবিশ্বাস্য লাগে! তারপর মাঝেমধ্যে কাজিনদের চকচকে সাইকেল নিয়ে বাড়ির পেছনের রাস্তাটা ধরে এগোতাম, আশপাশের লোকজনের অবাক দৃষ্টিতে ছোট্ট বুকটা গর্বে ভরে যেত। তবু বলা হয়ে ওঠেনি আব্বা আপনাকে ভালোবাসি।
আমার বড় ভাই–বোন বর্ষাকালে অনেকের সঙ্গে ডিঙিনৌকায় চেপে নদীর ওপারের স্কুলে যেত। একবার তাদের নৌকাডুবি হলো। আশপাশের নৌকা এসে উদ্ধার করেছিল। এরপরই আপনারা কঠিন সিদ্ধান্ত নেন...তারপর পরিচিত সে গ্রাম, চেনা জনপদ, বহেড়াতলীর হাট, বংশাই নদ, স্কুল, পুরোনো মসজিদ...সব পেছনে ফেলে বুকের ভেতর শূন্যতা আর ভাঙন চেপে, গরুর গাড়িতে চড়ে বসলেন। পেছনে রইল বন্ধু, স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী। মায়ামমতায় ছাওয়া ঘরবাড়ি, উঠান, আম, কাঁঠাল, বেল, পেয়ারা বা ডালিমগাছের মায়া ছেড়ে অচেনা মফস্বলে আশ্রয় নিলেন। যেখানে সবকিছুই নতুন করে গড়া লাগে। উঠানজুড়ে সেখানে বড় বড় মাটির ঢেলা। নতুন গাছ লাগানো, কখনো মাটির চুলা বানানো, কত কাজ!
তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। বাড়ি এলে বাসের ফার্স্ট ট্রিপ ধরে হলে ফিরতাম। বাসা থেকে স্টেশনে হেঁটে গেলে ভোরের বাস মিসের আশঙ্কা ছিল। মনে আছে, এত বড় মেয়েকে সাইকেলে স্টেশনে পৌঁছে দিতেন। আব্বা আপনাকে বলা হয়নি, আমার আনন্দ হাসি, কান্না বা রাগ, অভিমান নিশ্চিন্তে ঝেড়ে ফেলার জায়গা ছিলেন আপনি।
যার কারণে পৃথিবী দেখি, আকাশ দেখি; সেই ছায়াটিই সরে গেল কখন! সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই প্রার্থনা, সেই ছায়ায় মায়ায় মাখামাখি মুখ আবার দেখিয়ো প্রভু।