বাড়ির সামনে গাড়ি নয়, রাখা আছে একটা আস্ত বিমান!
উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দালানগুলোর ফাঁকে হঠাৎ একটা ডানাভাঙা বিমান আপনাকে চমকে দিতে পারে। এই চমকই অবশ্য কলেজ অব এভিয়েশন টেকনোলজির (ক্যাটেক) ঠিকানা খোঁজার কাজটা সহজ করে দিল। রাস্তার মোড়ে দাঁড়ানো এক রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘সামনে গেলে ডান দিকে দেখবেন একটা পেলেন আছে। পেলেনের উল্টা দিকে কলেজ।’
পুরোনো, পরিত্যক্ত ‘পেলেন’টা আশপাশের লোকজনের কাছে চমক জাগানিয়া হলেও, কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে ব্যবহারিক ‘ক্লাসরুম’। কলেজ অব এভিয়েশন টেকনোলজিতে যেই তরুণেরা পড়ছেন, বিমানকে ঘিরেই তাঁদের পড়ালেখা, স্বপ্ন। ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে গত মঙ্গলবার হাজির হয়েছিলাম প্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাসে।
স্বপ্ন মেলেছে ডানা
‘আপনাদের মধ্যে ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন কে কে?’ প্রশ্ন করতেই অনেকগুলো হাত উঠল। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের একটা ক্লাসে ঢুকে পড়েছিলাম আমরা।
‘এভিয়েশন নিয়ে পড়ছেন, কেমন লাগছে?’
‘ভালো।’ উত্তর এল সমস্বরে।
আলাপটা এর বেশি এগোনো গেল না। শিক্ষক ঢুকলেন ক্লাসে। ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা এরপর আরেকটা ক্লাসে ঢুঁ মারি। এখানে দু–একজনের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ হলো।
ঢাকা কমার্স কলেজের ছাত্র ছিলেন মো. পিয়াল মোল্লা। ছোটবেলায় এক প্রতিবেশীকে বিমানের কেবিন ক্রু হিসেবে কাজ করতে দেখেছেন। আগ্রহ জেগেছে পিয়ালের। বলছিলেন, ‘ওই প্রতিবেশীকে দেখতাম তিনি নানা দেশে ঘুরে বেড়ান। মনে হলো এটা বেশ একটা স্মার্ট জব। উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর ইচ্ছা ছিল কানাডায় গিয়ে এভিয়েশন ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়ব। খোঁজখবর নিলাম। দেখলাম বিদেশে পড়ার খরচ অনেক। তাই দেশেই ভর্তি হয়ে গেলাম।’ ক্যারিয়ার নিয়ে এরই মধ্যে পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছেন পিয়াল। বললেন, ‘ইচ্ছে আছে, পড়ালেখা শেষ করে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার হব।’
দ্বিতীয় বর্ষের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে আমরা বসলাম একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে। ‘আপনাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছাত্র কে?’ প্রশ্ন করতেই সব চোখ ঘুরে গেল শুয়াইব হাসানের দিকে। মিরপুরের বিসিআইসি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পেরোনো তরুণ লাজুক হেসে বললেন, ‘বাইরে পড়তে যেতে হলে সিজিপিএ অন্তত ৩.৫০ থাকতে হয়। সে জন্য পড়ালেখাটা একটু ভালোভাবে করার চেষ্টা করছি। এভিয়েশন সায়েন্স অনেক বড় পরিসরের একটা বিষয়। যেকোনো একটা দিক নিয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হলে আরও পড়তে হবে।’
পড়ার বিষয়টা বেশ কঠিন। ভালো রেজাল্ট ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন কেউ কেউ। ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ পেল কয়েকজনের কথায়। শুয়াইব অবশ্য জোর গলায় বললেন, ‘আমাদের বিষয়টা এমন—কারও যদি রেজাল্ট ভালো হয়, কেউ যদি আগ্রহ নিয়ে পড়ে, তাহলে চাকরি বা উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবতে হয় না।’ তবে এ কথা বোধ হয় যেকোনো পড়ার বিষয়ের ক্ষেত্রেই সত্য। এভিয়েশন সায়েন্সের পড়ালেখায় একটা বড় অংশই হলো ব্যবহারিক শিক্ষা। সেই আয়োজন চোখে পড়ল কলেজ ভবনের নিচতলায়। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রাখা আছে বিমানের নানা যন্ত্রাংশ। কখনো কখনো বিমানবন্দরে গিয়ে হাতে-কলমে শেখার সুযোগও পান এখানকার ছাত্রছাত্রীরা। দ্বিতীয় বর্ষের তাহমিদ আহমেদ বললেন, ‘কক্সবাজার বিমানবন্দরে আমরা এক সপ্তাহের একটা প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম।’
ভিনদেশে ইন্টার্নির সুযোগ
প্রথম বর্ষ থেকেই ভিনদেশে ইন্টার্ন করার সুযোগ পান ক্যাটেকের কোনো কোনো শিক্ষার্থী। যাঁরা পড়ালেখায় ভালো, নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারেন, অগ্রাধিকার পান তাঁরা। শিক্ষার্থীরা বলছিলেন, তাঁদের বন্ধুদের মধ্যে কেউ ভারত, কেউবা সংযুক্ত আরব আমিরাতে আছেন। কয়েক মাস শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করে ফিরে এসে আবার তাঁরা কলেজের নিয়মিত পড়ালেখায় যোগ দেবেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড স্পেস সায়েন্সেসে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করছেন কলেজ অব এভিয়েশন টেকনোলজির ছাত্রী জারিন খান। ই–মেইলে যোগাযোগ হলো তাঁর সঙ্গে। জারিন লিখেছেন, ‘এভিয়েশনের ছাত্রী হিসেবে একটা গবেষণা প্রকল্পে কাজ করা ছিল আমার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখন আমরা একটা কিউবস্যাট (মহাকাশ গবেষণায় ব্যবহৃত হয়, এমন একটি ছোট আকৃতির স্যাটেলাইট) প্রকল্পে কাজ করছি।’
জারিনের মতো শিক্ষার্থীরা যেন ভিনদেশের কাজের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন, সেভাবেই তাঁদের প্রস্তুত করতে চান ক্যাটেকের শিক্ষকেরা। কথা হলো কলেজের প্রভাষক মাশরুফা খানের সঙ্গে। বললেন, ‘এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে। ফলে আমাদেরও শিক্ষার্থীদের সেভাবেই পড়াতে হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি সব সময় চেষ্টা করি, ছেলেমেয়েরা যেন সাম্প্রতিক জ্ঞানটা পায়। আমি দেশের বাইরে গেলেই নতুন বই নিয়ে আসি, নয়তো বিদেশ থেকে কেউ এলে তাঁকে দিয়ে বই আনাই।’
আকাশ আর আকাশযান নিয়ে পড়ালেখা, সেই তুলনায় ক্যাম্পাসের পরিসরটা একটু ছোট। কলেজের অধ্যক্ষ মণি সরকার সেটা মেনে নিয়েই বললেন, ‘এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য আসলে অনেক বড় জায়গা দরকার। ঢাকার ভেতরে এত বড় জায়গা কোথায়? ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য যা যা দরকার, তার সবই কিন্তু আমাদের আছে। এটা ঠিক, ক্যাম্পাসটা আরও বড় হলে ছাত্রছাত্রীরা পড়ালেখাটা আরও উপভোগ করত। আমাদের বড় কিছু করার পরিকল্পনা আছে।’
কলেজকথন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এই কলেজে দুটো বিষয়ে স্নাতক করার সুযোগ আছে—
১. অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড এভিয়েশন সায়েন্স (বিএসসি)
২. এভিয়েশন ম্যানেজমেন্ট (বিবিএ)
অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড এভিয়েশন সায়েন্স বিষয়ে মূলত বিমান–সংক্রান্ত বিজ্ঞান ও প্রকৌশল নিয়ে পড়ানো হয়। এভিয়েশন ম্যানেজমেন্টের ছাত্রছাত্রীরা শিখছেন বিমান, বিমানবন্দর এবং এই খাত–সংক্রান্ত নানা ব্যবস্থাপনার কৌশল।
কলেজ অব এভিয়েশন টেকনোলজি ২০১৬ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পেয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, এখন প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে প্রায় ১৭৫ জন শিক্ষার্থী আছেন। প্রতিবছর দুই বিভাগে ৫০ জন করে মোট ১০০ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি নেওয়া হয়। ভর্তি-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী।
দুটি বিষয়েই চার বছরের কোর্স। কলেজ কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড এভিয়েশন সায়েন্সে আট সেমিস্টারের বেতন, ভর্তি ফি, আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ দিতে হবে মোট ৭ লাখ ১০ হাজার ৫০০ টাকা। এভিয়েশন ম্যানেজমেন্টে ৮ সেমিস্টারের খরচ মোট ৪ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা। তবে যেহেতু নানা রকম বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তার সুযোগ আছে, এর চেয়ে কম খরচেও স্নাতক শেষ করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট: www.catechedu.com
মহাকাশচারী হতে চাই
ফারিহা রহমান
অ্যারোনটিক্যাল অ্যান্ড এভিয়েশন সায়েন্স
মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে যখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিই, তখন আমার ইচ্ছা ছিল বুয়েটে পড়ব। গণিতে এ মাইনাস পাওয়ার কারণে সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। ভর্তি হলাম কলেজ অব এভিয়েশন টেকনোলজিতে। প্রথম দিন ক্লাসে এসে একটু কেমন যেন লাগছিল। একটা মাত্র ভবন নিয়ে ক্যাম্পাস, খুব একটা ভালো লাগেনি। পরে আস্তে আস্তে সবার সঙ্গে মিশলাম।
প্রথম বর্ষে প্রথম সেমিস্টারে থাকাকালীনই আইএসডি নামে একটা সংস্থার মাধ্যমে ইন্টার্নশিপের সুযোগ পেলাম। স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোতে শুরু হয় আমার দুই মাসের ইন্টার্ন।
দুই মাসে দারুণ একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। ওখানে আমাদের সঙ্গে আরও ৯৯টি দেশের ৯৯ জন শিক্ষানবিশ ছিল। কেউ সৌদি আরব, কেউ ভারত থেকে এসেছে। কেউ তৃতীয় বর্ষ, কেউ চূড়ান্ত বর্ষ, কেউ স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। ওখানে আমি সবার ছোট। এর আগে দেশের বাইরে কখনো একা যাইনি। এটাই প্রথম। প্রথমে খুব একা লাগছিল। পরে আমার সুপারভাইজারের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আস্তে আস্তে সব সংশয় কেটে গেছে।
আমার কাজ ছিল ফ্লুইড ডায়নামিকস নিয়ে। কীভাবে একটা পাখি বা পোকা ওড়ে, সেটাই ছিল আমার গবেষণার বিষয়। দুই মাসের ইন্টার্ন শেষে একটা গবেষণাপত্র জমা দিতে হয়েছে।
ইন্টার্নের জন্য আমি মোটামুটি ভালো অঙ্কের বেতনও পেয়েছি। থাকা-খাওয়া, যাওয়া-আসা বাদেও বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পেরেছি। সব মিলিয়ে দারুণ একটা অভিজ্ঞতা।
স্কুলে পড়ার সময়ই ভারতীয় মহাকাশচারী কল্পনা চাওলার জীবনী পড়েছি। তাঁর গবেষণা, অভিযান, মৃত্যু—সব মিলিয়ে পুরো ঘটনাটিই আমাকে খুব আলোড়িত করেছে। স্নাতক শেষ করে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আমি কল্পনা চাওলার মতো মহাকাশচারী হতে চাই।