অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি চিকিৎসকদের পাশে : ডা. রেজা আলী

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক রেজা আলী। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক রেজা আলী। ছবি: সংগৃহীত
অস্ট্রেলিয়ায় অনুমোদিত চিকিৎসক হতে কঠিন পরীক্ষায় বসতে হয় বাংলাদেশি চিকিৎসকদের। পরীক্ষার কয়েকটি ধাপ উত্তীর্ণ হলে তবেই মেলে সনদ। সেই বৈতরণি পার হওয়া একসময় যেন অসম্ভব ব্যাপার ছিল। অসম্ভব কাজটি সম্ভব করতেই এগিয়ে এসেছিলেন ডা. রেজা আলী। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ও সহায়তা পেয়ে অনেক বাংলাদেশি চিকিৎসক হিসেবে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়ায়। রেজা আলীর জীবনের গল্প নিয়েই এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।

সে সময় সবকিছু কেমন যেন হুটহাট হয়ে যাচ্ছিল রেজা আলীর জীবনে। সিলেট মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করলেন। মাস চারেক চাকরি করলেন ঢাকার হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। ১৯৯৩ সালে তাঁর জীবনে যে পটপরিবর্তন শুরু হলো, সে তালিকায় যুক্ত হলো আরও একটি অধ্যায়—সেটা বিয়ে! ১৯৯৪ সালে রিজওয়ানা রাশীদ আলীর সঙ্গে জীবনের নতুন পর্ব শুরু করলেন। স্ত্রী তখন পরিবারের সঙ্গে থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন তড়িৎ প্রকৌশল পড়ছিলেন রিজওয়ানা রাশীদ আলী। বিয়ে সেরেই চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষার জন্য স্ত্রীসহ চলে যান ইংল্যান্ডে। লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসে ভর্তি হলেন। এ প্রতিষ্ঠান থেকেই জরুরি চিকিৎসাসেবার ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিলেন রেজা আলী।

বাংলাদেশি চিকিৎসকদের সঙ্গে রেজা আলী (পেছনের সারিতে বাঁয়ে)

১৬ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বসে রেজা আলী চিকিৎসকজীবনের কাহিনিই বলছিলেন। সেটা ১৯৯৮ সাল। দুই বছরের প্রশিক্ষণ নিতে সিডনি চলে আসেন রেজা আলী। অস্ট্রেলিয়ার চিকিৎসকদের কাজের পরিবেশ তাঁকে মুগ্ধ করে। চিকিৎসক হিসেবে এ দেশে প্রথম কাজ শুরু করলেন ভিক্টোরিয়া রাজ্যের বেনডিগো হাসপাতালে। সে সময়ই অস্ট্রেলিয়ান মেডিকেল কাউন্সিলের পরীক্ষায় বসেন। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ান কলেজ ফর ইমার্জেন্সি মেডিসিন থেকে জরুরি চিকিৎসাসেবার ওপর এফএসিইএম ডিগ্রি অর্জন করেন। এক বছর দায়িত্ব পালন করেন অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরার সরকারি হাসপাতালে। এরপর চলে আসেন সিডনির ওয়েস্টমিড হাসপাতালে। শিক্ষানবিশ চিকিৎসক থেকে একসময় বিশেষজ্ঞ হিসেবে পদোন্নতি হয় তাঁর। এভাবেই একদিন তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রথম বাঙালি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান কলেজ ফর ইমার্জেন্সি মেডিসিন থেকে জরুরি চিকিৎসাসেবায় পাস করে বের হন। দীর্ঘ ১২ বছর তিনি কাজ করেছেন ওয়েস্টমিড হাসপাতালে।

ভাবনায় বাংলাদেশি চিকিৎসক
অস্ট্রেলিয়ার জনস্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করার পর একটি বিষয় অনুধাবন করলেন রেজা আলী। কেন বাংলাদেশি চিকিৎসকের সংখ্যা কম? দেখলেন, লন্ডন থেকে পাস করা চিকিৎসকদের অস্ট্রেলিয়ার চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সনদ পাওয়া যতটা সহজ, বাংলাদেশ থেকে আসা চিকিৎসকদের জন্য ব্যাপারটা ততই কঠিন। রেজা আলী বলেছিলেন, ‘ভেবে দেখলাম, একটু নির্দেশনা আর একটু সহযোগিতা পেলে আমার দেশের চিকিৎসকেরা এ দেশে সাফল্য পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। সেটাই দেওয়া শুরু করলাম।’
সেটা প্রায় দেড় দশক আগের কথা। তখন ইন্টারনেটে এই পরীক্ষা সম্পর্কে এত বিস্তারিত জানার সুযোগ ছিল না। তাঁর সহযোগিতা পেলেন অনেকে। উত্তীর্ণ হলেন। এখন তাঁরা কাজ করছেন নিজের যোগ্যতায়। রেজা আলী যেমনটি বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা চিকিৎসকেরা নিঃসন্দেহে মেধাবী এবং যোগ্য; যা করার তাঁরাই করেছেন। আমি শুধু এ দেশের কায়-কানুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছি।’

স্ত্রী আর তিন ছেলের সঙ্গে রেজা আলী

বন্ধুর মতো নিঃস্বার্থ
অস্ট্রেলিয়ার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রাসেল আহমেদ। বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন ২০০৮ সালে। তখন তাঁর ছিল বুকভরা স্বপ্ন আর একজন ডাক্তারের ভিজিটিং কার্ড। সেই কার্ডটি ছিল রেজা আলীর। রাসেল আহমেদ বললেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। আমি অবাক হয়েছিলাম, তিনি আমাকে চেনেন না, জানেন না; শুধু বাংলাদেশি বলেই সাহায্য করলেন।’
শুধু এক রাসেল আহমেদই নন, অস্ট্রেলিয়ায় এমন অনেক মানুষের দেখা মিলবে, যাঁরা চিকিৎসক হিসেবে অনুমোদন কিংবা চাকরি পেতে রেজা আলীর সহায়তা পেয়েছেন। সিডনির স্প্রিংফার্ম মেডিকেল সেন্টারের অংশীদার বাংলাদেশি চিকিৎসক জসিম উদ্দিন বলছিলেন, ‘ডা. রেজা বন্ধুর মতো মানুষ। তাঁর সহায়তায় অনেক বাংলাদেশি চিকিৎসক অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে মেডিকেল সেন্টার চালু করেছেন। আবার অনেকে বিভিন্ন হাসপাতালের বড় পদে নিয়োগ পেয়েছেন।’
এমনই আরেকজন বাংলাদেশ মেডিকেল সোসাইটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের সভাপতি ও নিউ সাউথ রাজ্যের ওয়েশটার্ন লোকাল হেলথের জরুরি চিকিৎসা বিভাগের স্টাফ স্পেশালিস্ট শায়লা ইসলাম। রেজা আলীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ২০০৪ সালে। শায়লা বললেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা বেশির ভাগ চিকিৎসকের সঙ্গেই আগে থেকে তাঁর কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। এরপরও কেউ কোনো সহায়তা চাইলে রেজা নিজে থেকেই তাঁর জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ করেন। এরপর অস্ট্রেলিয়ার উপযোগী করে নিজে সেই সিভি ঠিক করে দেন।’
বাংলাদেশের চিকিৎসক যাঁরা এ দেশে আসেন, তাঁদের বেশির ভাগই আগে থেকেই রেজা আলীর কথা শোনেন। সিডনির অমরাবতী ফ্যামিলি মেডিকেল ট্রাস্ট ও আরও দুটি চিকিৎসাকেন্দ্রের অংশীদার চিকিৎসক সুরঞ্জনা জেনিফার রহমান বলেন, ‘অস্ট্রেলীয় চিকিৎসক হিসেবে গড়ে ওঠার ভিতটা তিনি তৈরি করে দেন। আর এ কাজে রেজা আলী সেরা।’

অস্ট্রেলীয়দের মুখেও প্রশংসা
‘পেশাগত কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি। তবে নিজের কাজের মাধ্যমে অন্যের মনেও দেশের প্রতি ভালোবাসা জাগানো মানুষ দেখেছি হাতে গোনা। রেজা আলী তাঁদের একজন।’ এমনটাই বলছিলেন ইমার্জেন্সি মেডিসিনের উপপরিচালক ডেভিড মেলভিন। তিনি যোগ করেন, নিজের অবস্থান থেকে নিজের দেশ থেকে আসা মানুষদের যেভাবে সাহায্য করেন রেজা, সেটা দেখে যে কারোরই দেশপ্রেম বেড়ে যাবে। সবাই যদি আমরা রেজার মতো এমন নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতাম, তবে পৃথিবীতে এত সমস্যাই থাকত না।’

হিরো অব দ্য অস্ট্রেলিয়া
শুধু বাংলাদেশিদের যে রেজা আলী সহযোগিতা করেন, এমন নয়; ভারত, শ্রীলঙ্কা, সিরিয়া, ভুটান, নেপাল, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আসা চিকিৎসক ও সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করেছেন তিনি। এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সরকার ২০১২ সালে রেজা আলীকে ‘হিরো অব দ্য অস্ট্রেলিয়া’ পদকে সম্মানিত করে। এ ছাড়া চিকিৎসাসেবার মান উন্নয়নে অবদানের জন্য তাঁকে অস্ট্রেলিয়ার গভর্নর জেনারেল দেশটির স্বাস্থ্য প্রতিনিধি হিসেবে সম্মানিত করেছে।

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ডের সঙ্গে রেজা আলী

বাবার কাছে সেবার মনোভাব, মায়ের কাছে মূল্যবোধ
সিলেটের কানাইঘাটে রেজা আলীদের পৈতৃক বাড়ি। তাঁর বাবা এম এম আলী ছিলেন সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের সার্জন। তাঁর বাবা ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করতে গিয়ে বিয়ে করেন মা প্যাট্রিসিয়া লর্ডকে। সেখানেই রেজা আলীর জন্ম। পরে মা-বাবার সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। বাবা এম এম আলীর কাছেই পেয়েছেন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা। তিনি দেখেছেন, সিলেটের গ্রামাঞ্চল থেকে তাঁর বাবার কাছে চিকিৎসা নিতে আসা অনেককেই রেলস্টেশন থেকে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে আসতেন। যাদের সামর্থ্য নেই, তাদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা দিতেন এম এম আলী। থাকার ব্যবস্থা করতেন বাড়িতেই। রেজা আলী বলছিলেন, ‘বাবার সেই আদর্শটাই লালন করছি।’
মায়ের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন আলাদা মূল্যবোধ। রেজা আলী বললেন, ‘বিলেতে পাঁচ ভাইবোনের বড় পরিবার ছেড়ে বাবার সঙ্গে মা চলে আসেন। নিজের দেশ, পরিবার, সংস্কৃতি ছেড়ে চলে আসার সিদ্ধান্ত খুব কঠিন ছিল। এ শিক্ষা পরিবারের প্রতি আমার ভালোবাসা বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিবারকে ভালোবাসার মূল্যবোধটা আমার মায়ের কাছে শেখা।’
অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর মা রাজধানীর আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে ইংরেজি পড়াতেন। এক বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট রেজা আলী। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে ঢাকাতে। আদমজী থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ভর্তি হন সিলেট মেডিকেল কলেজে। এরপর লন্ডন হয়ে অস্ট্রেলিয়ায়।
একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান স্ত্রী রিজওয়ানা রাশীদ আলী আর তিন ছেলে নিয়ে তাঁর বসবাস সিডনিতেই। স্ত্রী সম্পর্কে বলছিলেন, ‘আমি যখন লন্ডনে পড়ি, তখন তো আমার তেমন কিছু ছিল না। আমার টিউশন ফি জোগাতে রেজওয়ানা নিজের পড়াশোনা সাময়িক বন্ধ রেখে কাজ করেছে। আমার কোনো কাজে কখনো বাধা দেয়নি। তাঁর সহযোগিতা না পেলে আমি হয়তো এ পর্যন্ত না–ও আসতে পারতাম।’

বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন
রেজা আলী স্বপ্ন দেখেন, বাংলাদেশে জরুরি চিকিৎসাসেবার বিপ্লব ঘটবে। বাংলাদেশের জরুরি সেবার মান উন্নয়নে এরই মধ্যে একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করেছেন তিনি। বাংলাদেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের পড়াশোনায় জরুরি চিকিৎসাসেবার গুরুত্ব বাড়াতেও কাজ করছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি সেবার শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণের জোগান দেন তিনি। তবে তাঁর উদ্যোগগুলো এখনো তেমন ফলপ্রসূ নয় বলে জানালেন। বললেন, ‘এর একটা প্রধান কারণ, জরুরি সেবা কতটা জরুরি—এ ধারণাটা বাংলাদেশে এখনো গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে না। বাংলাদেশে শুধু জরুরি সেবার অভাবে কোনো দুর্ঘটনার পর অনেক আহত ব্যক্তি মারা যান। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এই সেবাকে বেশ প্রাধান্য দেওয়া হয়।’
তবে ধীরে হলেও এই দৃশ্যপট বদলাচ্ছে, মনে করেন রেজা আলী। পেশার পাশাপাশি কমিউনিটিভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত আছেন রেজা আলী। রাজ্য ও ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন কমিটির পাশাপাশি কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসেবে যুক্ত রয়েছেন বাংলাদেশ মেডিকেল সোসাইটি অব নিউ সাউথ ওয়েলসের সঙ্গে।