অস্ট্রেলিয়ায় পড়ে স্টেশনারি দোকানি

নিজের দোকানে তনিমা আফরোজ। ছবি: খালেদ সরকার
নিজের দোকানে তনিমা আফরোজ। ছবি: খালেদ সরকার
অস্ট্রেলিয়ায় পড়ে স্টেশনারি দোকানি ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়া থেকে অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফিন্যান্স বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন বাংলাদেশের মেয়ে তনিমা আফরোজ। কয়েক বছর সেই দেশে চাকরিও করেছেন। এরপর দেশে ফিরে স্টেশনারির দোকান দিয়ে শুরু করলেন ব্যবসা। কেন উদ্যোক্তা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি?

ঢাকার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) ক্লাসে শিক্ষক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমরা কে কী হতে চাও?’ কেউ বলেছিল ব্যাংকার, কেউ বলেছিল করপোরেট প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। ব্যবসায়ী হওয়ার কথা বলতে হাত তুলেছিল একজনই। সেই হাতটা তনিমা আফরোজের।

ছোটবেলা থেকেই তনিমার লক্ষ্য খুব পরিষ্কার ছিল—ব্যবসায়ী হব। ইউআইইউ থেকে স্নাতক শেষ করে ২০১২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি গিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়া থেকে অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফিন্যান্স বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করে একটি পেশাগত কোর্স করেছেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার সরকারি প্রতিষ্ঠান টেকনিক্যাল অ্যান্ড ফারদার এডুকেশনে (টেফ) চাকরি করেছেন দুই বছর। কিন্তু ব্যবসার ‘ভূত’ তাঁর মাথা থেকে নামেনি। গত বছর দেশে ফিরে তিনি একটি স্টেশনারির দোকান দিয়েছেন। দোকানটি ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজের কাছেই অবস্থিত, নাম গার্নার থিওরি লিমিটেড। পেনসিল, কলম, নানা ধরন ও রঙের কাগজ, বাচ্চাদের টুকিটাকি খেলনা থেকে স্থাপত্যের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপকরণ, কত কী পাওয়া যায় এই দোকানে! গত মঙ্গলবার দোকানে বসেই কথা হলো তনিমার সঙ্গে।

ভিনদেশের জীবন, ভালো চাকরি ছেড়ে এসে কেন তিনি ব্যবসায়ী হওয়ার ঝুঁকি নিলেন?

লক্ষ্য ছিল একটাই

মাগুরা গভ. গার্লস হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা সিটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়েছেন তনিমা। বাবা ইস্কান্দার মির্জা ও মা শামীম আফরোজ—দুজনই ব্যবসায়ী। সে জন্যই কি শুরু থেকেই ব্যবসায়ী হওয়ার ইচ্ছে ছিল? তনিমা বলেন, ‘ঠিক তা নয়। ছোটবেলা থেকে ব্যবসার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল। বলে না...“বিজনেস ম্যাগনেট”; শব্দটার মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণ আছে। তখনো কিন্তু পৃথিবীতে, বিশেষ করে বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রতি এতটা জোর দেওয়া হয়নি। কিন্তু আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম। যা-ই পড়ি, যা-ই করি, ব্যবসায়ী হব।’

কাগজ, পেনসিল থেকে শুরু করে স্থাপত্যের শিক্ষার্থীদের কাজে লাগে, এমন নানা পণ্য আছে তনিমার দোকানে।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকেই নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করেছেন তনিমা। ক্লাসে বিভিন্ন গ্রুপওয়ার্কের জন্য যখন দল গঠন করতে হতো, তখন থেকেই একটি দলের সঙ্গে কীভাবে মিলেমিশে কাজ করতে হয়, সেই চর্চা করতেন তিনি। মাথায় থাকত—ব্যবসা করতে হলে তো আমাকে একদল মানুষের সঙ্গে কাজ করতেই হবে। তনিমা বলেন, ‘ইউনিভার্সিটির গ্রুপওয়ার্কগুলোতে দেখা যায়, দলের সবাই কাজ করে না। দু–একজন পুরো দায়িত্ব নিয়ে নেয়। আমি চেষ্টা করতাম, সবার কাছ থেকে তাঁর কাজটা আদায় করে নিতে।’ এখন ছোটখাটো একটা দলের সঙ্গে প্রতিদিন কাজ করতে হচ্ছে তাঁকে। গার্নার থিওরি লিমিটেডে আছেন ছয়জন কর্মী।

ব্যবসার পুরো পরিকল্পনাটা অস্ট্রেলিয়াতে বসেই করেছিলেন তনিমা। দোকানের নাম কী হবে, কোথা থেকে কী কিনবেন, ব্যবসার কৌশল কী হবে—কাগজে-কলমে সব সাজিয়েছিলেন তিনি। তনিমা মনে করেন, ব্যবসার চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটা আনন্দ আছে। স্বাধীনতা আছে। কিন্তু এত ধরনের ব্যবসা থাকতে স্টেশনারির দোকানই কেন?

পেনসিলে আঁকা স্বপ্ন

‘খেয়াল করে দেখবেন, দোকানে গিয়ে আমরা বলি, “একটা পেনসিল দিন তো।” খুব কম মানুষই বলেন, আমাকে অমুক পেনসিলটা দিন। কিংবা তমুক কলমটা দিন। আমি কলম-পেনসিল কেনার ক্ষেত্রেও মানুষের মধ্যে “ব্র্যান্ড”–এর ধারণা তৈরি করতে চাই। মানুষ যেন তাঁর শখের জিনিসটা খুঁজে নেয়।’ বলছিলেন তনিমা। তিনি মনে করেন, স্টেশনারির একটা বড় বাজার আছে। অনেকেই শখ করে একটু অন্য রকম খাতা-কলম-পেনসিল কিনতে চান। শখের জিনিসগুলো এক ছাদের নিচে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন তনিমা। স্থাপত্যের শিক্ষার্থী বা যাঁরা কারুশিল্পে আগ্রহী, তাঁদের হাতেও মানসম্পন্ন উপকরণ তুলে দিতে চান তিনি।

একজন ক্রেতা যেন শুধু পণ্য নয়, সেবাও পান—সেটি নিশ্চিত করতে চান তনিমা। একদিনের ঘটনা বললেন তিনি, ‘পাশের একটি স্কুল থেকে কয়েকজন শিক্ষক এসেছিলেন কিছুদিন আগে। শুরুতে দোকানে পা রেখে তাঁরা একটু বিরক্ত ছিলেন। বলছিলেন, এত দাম কেন, এটা কেন, সেটা কেন? আমি গিয়ে কথা বললাম। বললাম আপা, আপনারা কফি খাবেন? কথা বলতে বলতে সম্পর্কটা সহজ হয়ে গেল। চলে যাওয়ার সময় তাঁরা খুব খুশি ছিলেন। বললেন, আবার আসবেন।’ ক্রেতাদের এই আনন্দই তনিমাকে প্রেরণা দেয়।

শুধু যে প্রেরণা আর আনন্দই পাওয়া হচ্ছে, তা নয়, ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হতে হচ্ছে তাঁকে। কী সেই চ্যালেঞ্জ?

সমস্যা সমাধানের আনন্দ

তনিমার ব্যবসায় একমাত্র বিনিয়োগকারী ছিলেন তাঁর মা–বাবা। কেমন করে তাঁদের বোঝালেন? ‘অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোন করে আমার আইডিয়ার কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, দেখো, তোমাদের এই বিনিয়োগ নষ্ট হবে না। তোমরা যাকে টাকাটা দিচ্ছ, সে একদিন কোটিপতি হবে!’ বলেই হেসে ফেললেন তনিমা। হাসিতে আনন্দের সঙ্গে মিশে আছে নিখাদ আত্মবিশ্বাস।

তনিমা বলেন, ‘অনেকে বলেন, উদ্যোক্তা হতে চাই। কিন্তু মা-বাবা রাজি নন। আমি মনে করি মা-বাবাকে রাজি করানোই একজন উদ্যোক্তার প্রথম চ্যালেঞ্জ। আমি যদি ঘরের মানুষকে বোঝাতে না পারি, তাহলে বড় বড় বিনিয়োগকারীকে বোঝাব কী করে?’

মা-বাবাকে বোঝাতে অবশ্য তনিমাকে খুব বেগ পেতে হয়নি। পাড়াপড়শি-স্বজনেরা নানা কিছু বলেছে। ‘মেয়েকে একা একা বিদেশে পাঠালে কেন? বিদেশে গেলই যখন, ফিরে এল কেন? বিয়ে দিচ্ছ না কেন? কী সব ব্যবসা করছে, কিছু বলছ না কেন?’ মানুষের নানা কথার তোয়াক্কা না করে তনিমার মা-বাবা মেয়ের ওপর আস্থা রেখেছেন।

মা-বাবার পাশাপাশি একদিন সারা দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করতে চান তনিমা। তিনি চান মানসম্পন্ন স্টেশনারি পণ্যের জন্য লোকে গার্নারের ঠিকানা খুঁজে নিক। শিগগিরই অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেটওয়ার্ক বড় করছেন, নতুন নতুন পণ্য যোগ করছেন।

১০ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান? প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তাঁর চোখ ঝলমল করে উঠল, ‘আমি চাই, সারা দেশে গার্নারের প্রায় ২০০ শাখা থাকবে। ভালো মানের পণ্যের জন্য মানুষ গার্নারেই আসবে।’