কামরুল হোসাইন চৌধুরী

অস্ট্রেলিয়ায় পেলেন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা

সিডনির অপের হাউসের সামনে কামরুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি: লেখক
সিডনির অপের হাউসের সামনে কামরুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি: লেখক

সিডনিতে তখন শেষ বিকেল। পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছে অপেরা হাউসের গায়ে। অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত এই স্থাপনা যেন বাড়তি সৌন্দর্য মেলে ধরেছে সে আলোয়। তার পাশে দাঁড়িয়েই আমাদের আলাপ শুরু হয়েছিল। কামরুল হোসাইন চৌধুরী তখন মেলে ধরেছেন তাঁর জীবনের খেরোখাতা। উত্থান-পতনের গল্প শেষে এই বাংলাদেশি একসময় এলেন অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননার কথায়। যে সম্মাননার সূত্র ধরে তো তাঁর সঙ্গে ১৯ ফেব্রুয়ারির সেই আলাপচারিতা।

আনন্দিত করেছে ‘বাংলাদেশি’ শব্দটি

অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দিবসে প্রতিবছর দেশটির নাগরিকদের সম্মাননা জানাতে নাম ঘোষণা করা হয়। চলতি বছর বিভিন্ন বিভাগে সম্মাননা পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ‘মেডেল অব দ্য অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া’ পদক পাচ্ছেন এই বাংলাদেশি। দেশটির ভিক্টোরিয়া রাজ্যের রাজধানী মেলবোর্নের বাংলাদেশিদের সেবায় দীর্ঘদিন অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে কামরুল হোসাইন চৌধুরীকে এই সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে।

কামরুল বলছিলেন, ‘সম্মাননা প্রদানের কারণ হিসেবে চিঠিতে যখন লেখা ছিল, ফর সার্ভিস টু দ্য বাংলাদেশি কমিউনিটি অব মেলবোর্ন। চিঠির সেই ‘‘বাংলাদেশি’’ শব্দটা আমাকে সবচেয়ে আনন্দিত করেছে।’

সমাজসেবায় তাঁর অনেক কাজের মধ্যে বেশ কয়েকটির কথা উল্লেখ করে সরকারের সম্মাননা প্রদান কমিটি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনাশিল্পের প্রযুক্তি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পিএনএস গ্রুপ এবং সামাজিক সংগঠন বাংলাদেশ সমিতির নামসহ আরও ছিল ওয়েস্টার্ন রিজিয়ন বাংলা স্কুলের পৃষ্ঠপোষকতা এবং ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের জন্য বাস অনুদান, ভিক্টোরিয়া রাজ্যের বিভিন্ন বাংলাদেশি সংগঠনে নানাবিদ অনুদান, অস্ট্রেলিয়া তথা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অবদান ইত্যাদি।

জিজ্ঞেস করেছিলাম অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে কখনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাবেন, ভেবেছিলেন? হাসলেন কামরুল চৌধুরী। বললেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি সেই দেশ স্বাধীনের পরপর। কম সময় তো হলো না। তবে ছোটবেলা থেকেই আমার সব সময় সবখানেই মানুষের পাশে থাকতে ভালো লাগত। আর কিছু না হোক, একটা ভালো মুহূর্ত যেন মানুষকে দিতে পারি; অতটুকুন চেষ্টাই আমি জীবনভর করে এসেছি। এর বেশি কিছু না।’

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কামরুল ইসলাম চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধ, জীবনযুদ্ধ

আনোয়ার হোসেন চৌধুরী ও আকলিমা চৌধুরী দম্পতির প্রথম সন্তান কামরুল চৌধুরী। জন্ম ১৯৫২ সালে, পাবনায়। স্কুল-কলেজ সেখানেই। ভূগোল বিষয়ে স্নাতক পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

অংশ নিয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। ৭ নম্বর সেক্টরের যোদ্ধা হিসেবে পাবনায় সশস্ত্র যুদ্ধ করেছেন। স্মৃতিকাতর হয়ে সে সময়কার কথা বললেন কামরুল, ‘সত্তরের দশকের গোটা সময়টা এখনো ছবির মতো আমার সামনে ভাসে। যুদ্ধের ৯টা মাস। এক সম্মুখযুদ্ধে শত্রুর গুলি লেগেছিল, ক্ষত সেরে গেছে, তবে দাগ রয়ে গেছে। যুদ্ধের পরবর্তী বেশির ভাগ সময় আমার কেটেছে বিভিন্ন পুনর্বাসন কার্যক্রমে।’

তারও পরে অস্ট্রেলিয়ার একটি সংস্থার হয়ে কাজ করতেন বাংলাদেশে। বললেন, ‘স্নাতক শেষে দেশেই কিছু করার পরিকল্পনা ছিল। তবে ১৯৭৫ এবং এর পরবর্তী সময়গুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হই। তখনই যে অস্ট্রেলিয়ান সংস্থাটির জন্য কাজ করতাম, তারা বলল স্নাতকোত্তর করতে অস্ট্রেলিয়া আসার জন্য। ১৯৭৭ সালে অবশেষে চলে এলাম অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে, এখানেই বাস করছি এখনো।’

সত্তরের দশকে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে বসবাস শুরু করা হাতে গোনা কজন বাংলাদেশিদের মধ্যে একজন কামরুল চৌধুরী।

একজন সফল ব্যবসায়ীও

অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছে যুবক কামরুল হোসাইন চৌধুরী পড়াশোনার পাশাপাশি অর্থ আয়েরও পথ খুঁজলেন। বললেন, ‘ঢাকায় এবং পাবনায় আমার বাবার ছাপাখানার ব্যবসা ছিল। সেগুলো দেখেই বড় হয়েছি। মুদ্রণযন্ত্রের সেই ধারণা থেকেই এসব যন্ত্রপাতি কেনাবেচার ব্যবসায় জড়িত হই। এক বছরের মধ্যে ১৯৭৮ সালে নিজের প্রতিষ্ঠান পিএনএস গ্রুপ গড়ে তুলি। ওখান থেকেই এখন ইউরোপ, আমেরিকা, চীনসহ বাংলাদেশ ও ভারতেও প্রিন্টিং মেশিন রপ্তানি করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশেও শাখা রয়েছে।’

বাংলাদেশ ভাবনা

দেশ ও স্বজনদের মায়া ছেড়ে জীবনের তাগিদেই একদিন বিদেশ–বিভুঁইয়ে চলে এসেছিলেন কামরুল চৌধুরী। এখন তিনি তিন কন্যার জনক। পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন তিনি। স্বামীর মতো পরোপকারী হিসেবে স্থানীয়দের কাছে কামরুল চৌধুরীর মতোই প্রশংসিত তাঁর স্ত্রী লায়লা চৌধুরীও।

কামরুল চৌধুরীর সঙ্গে আলাপনের মধ্য দিয়েই সেদিনকার মতো সিডনিতে সূর্য বিদায় নিতে শুরু করে। সন্ধ্যার ফিরতি ফ্লাইটে ফিরে যাবেন মেলবোর্নে। তবে দিনের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই শোনালেন দক্ষ আলোকিত মানুষ গড়ার তাঁর ইচ্ছার কথা। ‘কী করেছি, কী পেয়েছি সে হিসাব এখন আর করি না। তবে বাংলাদেশে দক্ষ প্রিন্টিং পেশাদার তৈরি করতে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করার একটা স্বপ্ন আছে আমার। যদি সরকার সহযোগিতা করে, তাহলে এখনই শুরু করতে চাই।’

অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া
১৯৭৫ সালে প্রবর্তন করা হয়েছে অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া। অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়ার প্রধান দুটি বিভাগ হচ্ছে—সামরিক ও বেসামরিক। দুটি বিভাগেই আবার চারটি করে উপবিভাগ রয়েছে। বেসামরিক বিভাগের একটি উপবিভাগ হচ্ছে ‘মেডেল অব দ্য অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া’।

গত ২৬ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দিবসে সম্মাননাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করেন দেশটির গভর্নর জেনারেল। এ বছর গভর্নর জেনারেল স্যার পিটার কোসগ্রোভ দেশটিতে অসাধারণ অবদানের জন্য সম্মাননা পাওয়া সবাইকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের জন্মদিনে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। এবার আগামী ২ এপ্রিল এ সম্মাননা প্রদান করা হবে। এ বছর সব বিভাগ মিলে ২১৩ অস্ট্রেলিয়ার নাগরিককে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য সম্মাননা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।