অসহায় শুভদের আছেন মালেক ভাই

আবদুল মালেক
আবদুল মালেক

শুভর বয়স তখন কতই হবে—৯ কি ১০ বছর। মাকে হারিয়ে করুণ কষ্টের দিন কাটছিল সৎমায়ের সংসারে। বঞ্চনার অভিমান তীব্র হলে চার বছর আগে বাড়ি ছেড়েছিল শুভ। দিনে দিনে নগরীর শত শত পথশিশুর একজন হয়ে উঠেছিল সে। তবে ঠিকানা একটা ছিল—টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশন। আরও কয়েকজন পথশিশুর সঙ্গে সেখানেই অনিয়মের দিন কাটত। আবদুল মালেকের সঙ্গে শুভর পরিচয়টা সেখানেই।

এ বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ট্রেন থেকে পড়ে ডান পা ভাঙে শুভর। তীব্র ব্যথা নিয়ে চিকিৎসা ছাড়াই দুই দিন থাকার পর আবদুল মালেককে স্মরণ করে শুভ। সে বুঝতে পারে, একমাত্র আশ্রয় এখন ‘মালেক ভাই’।

না, আবদুল মালেক শুভর কোনো আত্মীয় নন। তবে তিনি শুভর মতো অনেক পথশিশুর আপনজন। যারা দুর্দিনে পরিবারের একজন হিসেবে পাশে পায় ৪২ বছর বয়সী আবদুল মালেককে। তাই মালেকের কথা বলতে হলে শুভর বাড়ি ফেরার গল্পটাও বলতে হয়। এমন অনেক শুভকে নিয়েই যে তাঁর জীবনগল্প।

২২ এপ্রিল প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে শুভর গল্পে ফিরে আসি ফের। মাথার ট্রেডমার্ক নীল টুপিটা ঠিক করে আবদুল মালেক বলে যান, ‘কমলাপুর, বিমানবন্দর, টঙ্গী, নারায়াণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন রেলস্টেশনের পরিচিত পথশিশুদের বলা আছে, বিপদে পড়লে যেকোনো নম্বর থেকে আমাকে তিনবার মিসড কল দিতে। গত ২৯ জানুয়ারি শুভও অচেনা নম্বর থেকে আমাকে তিনবার কল দিয়েছিল।’

মালেক দ্রুত তাঁকে ভর্তি করান উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। সেখানেই চলে চিকিৎসা। ধীরে ধীরে পা সেরে ওঠে শুভর। ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়ালে, শুভকে নিয়ে হবিগঞ্জ জেলা সদরের দরিয়াপুর গ্রামে হাজির হন মালেক।

 ‘ঢাকা থেকে ভোরে যখন শুভদের বাড়িতে যাই, তখন এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল। পাড়া–প্রতিবেশী সবাই ছুটে আসে তাকে দেখতে। তিন বোন আর দুই ভাইয়ের মধ্যে শুভ সবার ছোট। ওরা ধরেই নিয়েছিল শুভ আর কোনো দিন বাড়িতে ফিরবে না। পরিবারের কাছে ফেরত দিতে পেরে নিজেকে নিজেই ধন্য মনে করছি।’

আবদুল মালেক শুভর সেই বাড়ি ফেরার মুহূর্তের ভিডিওটা ফেসবুকে শেয়ার করেছেন। সেখানেই দেখা যায়, শুভকে ফিরে পেয়ে আপ্লুত স্বজনদের সজল চোখ, যা অনেকের মনকে নাড়া দিয়েছে।

ছেলেকে ফিরে পাওয়ার মুহূর্তটা তাই শুভর বাবা আছন আলীর কাছে এখনো জীবন্ত। ২৪ এপ্রিল মুঠোফোনে যখন কথা হচ্ছিল, সেই আনন্দই যেন ধরা দিল। বললেন, ‘শুভ হারানোর পর প্রত্যেক আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থাইকা ঢাকা, সিলেটসহ কত জায়গায় যে খুঁজছি। কিন্তু পাইছি না। একদিন সকালে মালেক ভাই তারে নিয়ে হাজির। আল্লাহ তার ভালো করত।’

বাবার পাশেই ছিল শুভ। কথা বলতে চাইলে ছেলের হাতে মুঠোফোন ধরিয়ে দেন আছন আলী। অপর প্রান্ত থেকে কথা বলে যায় শুভ, ‘অপারেশনের তিন মাস হইছে, পায়ের অবস্থা এখন ভালো। মালেক ভাই অনেক ট্যাকা খরচ করে আমার অপারেশন করাই ভালা কইরা দিছে।’ সে যে আর বাড়ি থেকে পালাবে না, কিশোরসুলভ হাসিমাখা কণ্ঠে সে কথাটিও জানিয়েছিল শুভ।

যেভাবে তিনি ‘মালেক ভাই’

২০০৯ সালের কথা। জীবনে আলো ফেরানোর তাগিদে একদিন গাজীপুরে এসেছিলেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার আবদুল মালেক। একটি বেসরকারি সংস্থার মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার জৈনা বাজার এলাকায়। কাজের খাতিরে নিয়মিত আসতেন গাজীপুর চৌরাস্তায়। সেখানে পরিচয় হয় কয়েকজন হকারের সঙ্গে। চাকরির পাশাপাশি ফেরি করে পণ্য বিক্রি করতে থাকলেন। পুঁজি ৭০ টাকা। ৬০ টাকায় ১ কেজি যষ্টিমধু কিনে ছোট ছোট প্যাকেটে ভরেন। শুক্র ও শনিবার—এই দুই দিন ছুটির দিনে তাই নিয়ে বেরোতেন।

আয় হতে থাকে ভালোই। মাস কয়েক পর চাকরি ছেড়ে আবদুল মালেক হকারের পেশা বেছে নেন। ‘তখন আমার পরিবার অনেক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। অনেক দেনা ছিল। সেগুলো শোধ করার জন্যই লোকলজ্জার ভয় না করে বাসে বাসে যষ্টিমধু ফেরি করি।’

আবদুল মালেক এই পথশিশুদের আপনজন। ছবি: খালেদ সরকার

পণ্য ফেরি করতে করতেই একদিন গিয়েছিলেন বিমানবন্দর রেলস্টেশনে। উদ্দেশ্যহীন সেই যাওয়াটা অন্য এক জীবনে ঠেলে দেয় মালেককে। ঠেলে দেয় নাকি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুপ্ত ইচ্ছাটা জেগে ওঠে? মালেক বলে যান, ‘সেদিন আমার দারুণ এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে অভিজ্ঞতা ছিল পথশিশু হিসেবে বেড়ে ওঠা মানুষদের বন্ধনের বিষয়টি। দুজন একটু আগেই মারামারি করছিল; একটু পরই দেখি মিলমিশ।’ তাদের মাধ্যমেই পরিচিত হতে থাকে আরও কয়েকজন পথশিশুর। কখনো তাদের জন্য খাবার নিয়ে যান, কখনো আইসক্রিম হাতে, কখনোবা নিছকই গল্প করতে। এভাবেই আপনজন হয়ে ওঠেন আবদুল মালেক। এখন তিনি অনেক পথশিশুর কাছে ‘মালেক ভাই’।

আবদুল মালেক তখন থেকেই নিজের আয়ের কিছু অংশ থেকে খাবার কিনে শুক্রবার হাজির হতেন বিমানবন্দর স্টেশনে। এভাবেই অনেকের সঙ্গে পরিচিত হন। আবদুল মালেক বলেন, ‘পথশিশুরা প্রতিকূল পরিবেশেই বেড়ে ওঠে। ওদের রোগবালাই খুব কম হলেও খোসপাঁচড়া আর দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার হার বেশি।’

আবদুল মালেক খোসপাঁচড়ার সেবা দেন। তিনি বলছিলেন, ‘এটা সহজ। একটু পরিষ্কার থাকতে হয়। পরপর কয়েক দিন বাসায় এনে গোসল দিয়ে ক্ষতস্থানে খোসপাঁচড়ার মলম লাগিয়ে দিই। এভাবে কয়েক দিন ওষুধ দিলে সুস্থ হয়ে যায়।’ তিনিই জানালেন, হাজারখানেক পথশিশুকে তিনি এই খোসপাঁচড়ার সেবা দিয়েছেন। প্রতি বছর ঈদের সময় নতুন পোশাক নিয়ে হাজির হয়েছেন এই শিশুদের কাছে।

পথশিশুরাও পাবে স্বভাবিক জীব

২০১৪ সালে বাসে বাসে পণ্য বিক্রি করা ছেড়ে দেন আবদুল মালেক। তবে তত দিনে নগরীর অনেক মানুষ তাঁর পরিচিত হয়ে গেছে। বিশেষ করে ২০১১ সালে সুন্দরবনকে বিশ্বের নতুন প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনের প্রচারণার সময়টায়। সে সময় অনলাইন ভোটের প্রক্রিয়ার জন্য সচেতনতা তৈরি করতে হকার মালেক ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। নানা উপায়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন ভোটের জন্য। সে নির্বাচনে শেষ অবধি সুন্দরবন হারলেও হকার মালেককে চিনে যান অনেকেই। আর তিনি সন্ধান পান সুন্দরবনের মধুর।

সাতক্ষীরা থেকে প্রতিবছর চৈত্র–বৈশাখ মাসে মধু সংগ্রহ করেন। সেই মধু তিনি পৌঁছে দেন পরিচিত মানুষের কাছে। খাঁটি মধুর গ্রাহকও বাড়ে দিন দিন। এভাবেই তিনি হয়ে যান মধু ব্যবসায়ী। দিনভর যে মধুর সরবরাহের অর্ডার পান, তা নিয়েই বিকেলে বের হন বাসায় বাসায় পৌঁছে দিতে। এর ফাঁকেই চলে পথশিশুদের নিয়ে কাজ। মধু বিক্রি করে যা আয় হয়, তারই একটি অংশ খরচ করেন পথশিশুদের জন্য। মালেক বলেন, ‘বছরে আমি প্রায় চার হাজার লিটার মধু বিক্রি করি। আমার পরিবার থাকে গ্রামে। দুই সন্তান। যা আয় হয়, তা নিয়ে সুখেই আছি।’

তাঁর স্বপ্ন নিবন্ধিত সংগঠন করার। যার মধ্যমে বড় আকারে কাজ করবেন। পুনর্বাসন করবেন সমাজের মূলধারার বাইরে থাকা শিশুদের। যেমনটি তিনি বলছিলেন, ‘এই শিশুদের সীমাবদ্ধতার কথা আমি জানি। ওদের সম্ভাবনার কথাও আমি জানি। এই শিশুদের যত্ন নিলে, কর্মমুখী শিক্ষা দিলে ওরাও নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।’ মালেক মূলধারার মানুষ হিসেবে পথশিশুদের প্রতিষ্ঠা করার সেই কাজের সুযোগটাই চান।