সাঈদ রিমন পেশায় বস্ত্র প্রকৌশলী। অনেকের কাছে তিনি স্রেফ ‘সচেতনতার ফেরিওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নানা বিষয়ে ছবি পোস্ট করে মানুষের মধ্যে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দেন রিমন। অনেক সময় প্রচারপত্র হাতে হাজির হন স্টেশনে, স্কুলে, মাঠে। মাদকমুক্ত থাকা, ছিনতাইকারীর কবল থেকে বাঁচা, সড়কে দুর্ঘটনা এড়িয়ে পথচলাসহ প্রায় সাড়ে ৫০০ বিষয়ে সচেতনতামূলক ছবি রয়েছে তাঁর। নানা চরিত্রের বেশে তোলা সাঈদের কিছু আলোকচিত্র ব্যবহার করে মানুষকে সচেতন করছে বরগুনা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও নাটোর জেলা পুলিশ।
সচেতনতার বার্তা ছড়ানো সাঈদ করোনাকালে দাঁড়িয়েছেন অসহায় মানুষের পাশে। উদ্যোগে তিনি পাশে পেয়েছেন শুভাকাঙ্ক্ষীদের। তাঁদের সহায়তায় কেনা খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন অসহায় মানুষের হাতে, কখনো রান্না করা খাবারের প্যাকেট তুলে দিচ্ছেন রাজধানীর নিরন্ন মানুষের হাতে।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কথায় হয় সাঈদের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ শ মানুষের হাতে খাদ্যসামগ্রীর ব্যাগ তুলে দিয়েছেন তিনি। নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, আলু আর একটা সাবান নিয়ে ব্যাগে ভরা হয়। সে ব্যাগে তিন সদস্যের পরিবারের জন্য প্রায় সাত দিন চলার মতো খাবার থাকে। শুধু খাদ্যসামগ্রী বিতরণই নয়, বিমানবন্দর এলাকার তিন শ পথশিশু ও ভাসমান মানুষকে তিনি বিভিন্ন সময় রান্না করা খাবার খাইয়েছেন।
খাবার চেয়েছিল পথশিশু
করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ার পর সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হলো। বাসায় থাকার পরামর্শ দেওয়া হলো সবাইকে। মার্চ মাস শেষের সেই দিনে জরুরি কাজে সাঈদ গিয়েছিলেন বাসার বাইরে। রাজধানীর আশকোনার বাসা থেকে বেরোতেই দুজন পথশিশু এসে সামনে দাঁড়াল। বলছিলেন, ‘তারা করুণ স্বরে জানাল সারা দিন কিছু খায়নি। ভাত খাওয়ার জন্য কিছু টাকা চাইল।’
সাঈদ তাদের খাবারের ব্যবস্থা করলেন আর ভাবলেন অবরুদ্ধ ঢাকায় সাহায্য চাওয়া এ দুজনের মতো নিশ্চয় আরও অনেকে অনাহারে রয়েছে। বাসায় ফিরে স্ত্রী সাদিয়াকে বললেন সে ঘটনা। দুজনে ঠিক করলেন, অনাহারী মানুষের জন্য তাঁরা খাবার রান্না করে পৌঁছে দেবেন। প্রথম দিন রান্না করলেন ৩৫ জনের খাবার। সে খাবার পৌঁছে দিলেন বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন এলাকার অসহায় মানুষদের হাতে।
এমন আরও দু-এক দিন খাবার নিয়ে গেলেন সাঈদ। অসহায় মানুষেরা খাবার হাতে পেয়ে যে তৃপ্তির অনুভূতি জানান, তারই দু-একটা ছবিসহ পোস্ট করতেন ফেসবুকে। সেসব ছবি দেখে সাঈদের বন্ধু, সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষীরা এগিয়ে এলেন আর্থিক সহায়তার জন্য।
সে টাকাতেই দিনে দিনে প্রায় সাড়ে পাঁচ শ অসহায় মানুষ পেল খাদ্যসামগ্রী সহায়তা। অনেকেই পেল একবেলা খাবার।
সাঈদ বলেন, ‘আমার এই উদ্যোগের যারা সহযোগিতা করেছেন, তাঁরা আমার পরিচিত। তবে কাউকে আমি সহযোগিতা করতে বলিনি, সবাই নিজ দায়িত্বেই যুক্ত হয়েছেন। এই মানুষগুলো অনুপ্রাণিত হয়েছেন আমি বাসায় রান্না করে যে খাবার পরিবেশন করি, সেটা দেখে।’
বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় খাবার বিতরণে সাঈদ সহায়তা নেন বিমানবন্দর রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেনের। উদ্যোগ সম্পর্কে আকবর হোসেন বলেন, ‘বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে সচেতনতামূলক কাজ করেন রিমন সাহেব, সে সূত্রেই তাঁর সঙ্গে পরিচয়। করোনার প্রকোপের এই সময়ে অসহায় মানুষদের খাবার বিতরণের সময় সহায়তা চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়েছি।’
তিনি আরও জানালেন, বেশি মানুষের জন্য রান্নার বন্দোবস্ত হলে পুলিশ ফাঁড়ির খোলা জায়গায় তিনি ব্যবস্থা করে দেন। দিন কয়েক আগে ২০০ মানুষের জন্য ফাঁড়িতে খিচুড়ি রান্না করে বিলি করা হয়েছে। আকবর হোসেন বলেন, ‘আমার লোকবল দিয়েই সামাজিক দূরত্ব বাজায় রেখে অসহায় মানুষদের মধ্যে খাবার বিতরণ করেছি। তাঁর উদ্যোগটা প্রশংসনীয়।’
আছেন সচেতনতায়
চীনের উহান শহর থেকে করোনাভাইরাসের বিস্তার যখন দুনিয়াজুড়ে ছাড়িয়ে পড়তে থাকল, দেশেও জারি হলো নানা সতর্কতা, তখন মানুষকে সচেতন করতে সাঈদ ফেসবুকে ছবি পোস্ট করতেন। বারবার নিয়ম মেনে হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বাজায় রাখা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে যেসব সবজি খাওয়া প্রয়োজন- এসবই ছিল তাঁর প্রচারের বিষয়।
সাঈদ বলেন, ‘আমি মানুষের মধ্যে সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে আনন্দ পাই, কাজটাকে আমি দায়িত্বও মনে করি। ফেসবুক পোস্ট ছাড়াও গাজীপুরে আমার অফিসে যাওয়ার সময় বাসের যাত্রীদের সচেতন করি।’
সচেতনতার পাশাপাশি মানুষকে সহায়তার কাজ সম্পর্কে বললেন, ‘মানুষকে সহায়তার জন্য এভাবে আমি কখনো কাজ করিনি। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা, আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। যত দিন সম্ভব চালিয়ে যেতে চাই।’