অসহায়দের আশ্রয় আশিকুজ্জামান

মো. আশিকুজ্জামান
সংগৃহীত

সুন্দরবন নিয়ে কত কথাই তো বলা যায়, কত বিশেষণেই তো তুলে ধরা যায় বনটির গুরুত্ব। এই বন বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূল বন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় সুরক্ষাবলয় ইত্যাদি। কিন্তু খুলনার কয়রা উপজেলার বনজীবীদের কাছে? আয়ের অন্যতম একটি উৎস। কিন্তু সেখানে কাজ করতে গিয়েই বাঘের থাবায় প্রাণ হারাতে হয়েছে অনেককে। এই প্রাণ হারানো ব্যক্তির স্ত্রীদের বলা হয় বাঘবিধবা। স্থানীয় সমাজে অপয়া হিসেবে পরিচিত তাঁরা।

এই বাঘবিধবাদের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করছে মো. আশিকুজ্জামানের ইনিশিয়েটিভ ফর কোস্টাল ডেভেলপমেন্ট (আইসিডি)। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটি গড়ার উদ্যোগ নেন তিনি। এই প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও উপকরণ দিয়ে তাঁদের আর্থিকভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। শুধু বাঘবিধবাদেরই নয়, ওই উপজেলায় পিছিয়ে থাকা মুন্ডা সম্প্রদায়ের মানুষের উন্নয়নেও কাজ করছে আইসিডি।

শুরুর গল্প

মো. আশিকুজ্জামান তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁর নিজ এলাকা কয়রার মানুষের জন্য কিছু করার তাড়নাটা পুষে রেখেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরুর পর টিউশনির টাকা জমিয়ে প্রথমে বাঘবিধবাদের জন্য তিনটি সেলাই মেশিন বিতরণ করেন। বিষয়টি ফেসবুকে পোস্ট করার পর ব্যাপক সাড়া পান তিনি। শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহযোগিতায় বাঘবিধবাদের জন্য আরও সাতটি সেলাই মেশিন জোগাড় করে ফেলেন। ১০ জন বাঘবিধবা সেলাই মেশিন পেলে তাঁদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসে।

আশিকুজ্জামান বলেন, ‘বাঘবিধবাদের সাহায্যের পর আইসিডি নাম দিয়ে এলজি ইলেকট্রনিকসে একটি প্রকল্প জমা দেওয়া হয়। ব্যতিক্রমী কাজের জন্য এলজি ইলেকট্রনিকস বাংলাদেশ থেকে আমাকে তাদের কর্মসূচি দূত হিসেবে মনোনীত করে বাঘবিধবাদের কল্যাণের জন্য চার লাখ টাকা প্রদান করে। সেই অর্থ দিয়ে ৩০ জন বাঘবিধবাকে মাসব্যাপী দরজির কাজের প্রশিক্ষণ, সেলাই মেশিন ও প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রদান করা হয়।’

কয়রার পাশেই রয়েছে সুন্দরবন। সুন্দরবন ঘিরে পর্যটনকে মাথায় নিয়ে ইকো ট্যুরিজম করার ওপর গুরুত্ব দিয়ে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন আশিকুজ্জামান। ‘কেওড়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র’ গড়ে তোলেন। সেখানে এখন প্রতিদিন পর্যটক ভিড় করেন। কেওড়াকাটা পর্যটনকেন্দ্র থেকে ট্রলারে এক দিনের জন্য সুন্দরবন ঘুরে দেখা যায়।

শুধু বাঘবিধবাদেরই নয়, কয়রার মুন্ডা সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্যও কাজ করছে আশিকুজ্জামানের আইসিডি

আশিকুজ্জামান বলেন, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দরবন উপকূলবর্তী কয়রা উপজেলায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী মুন্ডা সম্প্রদায়, বাঘবিধবা ও অসহায় মানুষের কল্যাণে কাজ করে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানোর জন্যই আইসিডি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই ওই পরিকল্পনা করেছেন তিনি।

আইসিডির পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক মুন্ডা পরিবারকে সাহায্য করা হয়েছে। আর সাহায্য পাওয়া বাঘবিধবার সংখ্যা সাড়ে পাঁচ শতাধিক। অসচ্ছল তিন বনজীবী নারীকে নৌকা ও অসচ্ছল সাত নারীকে সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে আশিকুজ্জামানের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে। ওই কাজে সহায়তা করেছেন ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ১৯৯৮ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া ৩০ জন অসচ্ছল বনজীবী মুন্ডা নারীকে নৌকা দেওয়া হয়েছে। আগে ওই নারীরা নৌকা ভাড়া করে নদী থেকে মাছ-কাঁকড়া শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন ওই নারীদের আর নৌকা ভাড়া দিতে হয় না। আয়ের পুরোটাই থেকে যায়। তাঁরা এখন সচ্ছলতার পথে। আর মুন্ডাদের ওই নৌকা বিতরণকাজে আর্থিক সহযোগিতা করেছে এলজি ইলেকট্রনিকস বাংলাদেশ।

করোনাকালের এই সময় ও আম্পানের পর এলাকার মানুষের জন্য নানা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে আইসিডি। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় এলাকার প্রায় আট হাজার পরিবারকে খাদ্যসহায়তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মানুষের সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে সাতটি নলকূপ স্থাপন এবং আম্পানে বিধ্বস্ত ১০টি পরিবারকে টেকসই ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে আইডিসি।

আশিকুজ্জামান বলেন, ‘আমার উদ্যোগে ৮০ জন অসচ্ছল নারীকে টেকসই কর্মসংস্থানের বিভিন্ন উপকরণ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের জীবনে সফলতা ফিরে এসেছে।’

আশিকুজ্জামান আরও বলেন, ওই এলাকার স্কুল-কলেজে পড়া যুবকেরাই আইসিডির কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। এ কারণে তাঁদের মধ্যেও ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণা তৈরি হচ্ছে। এলাকার মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করছেন তাঁরা।