অরুন্ধতী একটি তারার নাম

কাছের মানুষেরা তাঁকে ডাকেন রায় বলে। স্থাপত্যের বন্ধুরা তাঁকে ডাকেন এস এ রায় (সুজানা অরুন্ধতী রায়) বলে। অপরিচিতদের কাছে তিনি অরুন্ধতী। তেমনটাই বলেন সাক্ষাৎকারে। ছবি: আনিসুল হক
কাছের মানুষেরা তাঁকে ডাকেন রায় বলে। স্থাপত্যের বন্ধুরা তাঁকে ডাকেন এস এ রায় (সুজানা অরুন্ধতী রায়) বলে। অপরিচিতদের কাছে তিনি অরুন্ধতী। তেমনটাই বলেন সাক্ষাৎকারে। ছবি: আনিসুল হক
ছবিমেলা উপলক্ষে ঢাকায় এসেছেন বুকারজয়ী ভারতীয় ঔপন্যাসিক ও লেখক অরুন্ধতী রায়। দ্য গড অব স্মল থিংসখ্যাত এই লেখক ৪ মার্চ ঢাকায় একটি গেস্টহাউসে বসে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর জীবনযাপন, পরিবার ও পছন্দের কথা জানিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তৌহিদা শিরোপা

দেখা হলে কী বলব, কী করব—কত কিছুই না মাথায় নিয়ে গেছি। এত বড় লেখকের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য জানা–বোঝার পাশাপাশি মনের প্রস্তুতিও দরকার হয়। যাঁর লেখা খুব পছন্দের তাঁকে যখন সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়, তখন মনের অবস্থা অনুমেয়। ৪ মার্চ প্রথম দেখাতেই হাত বাড়িয়ে মুখের হাসি প্রশস্ত করে উষ্ণ অভিবাদন জানালেন। শুরু হলো প্রথম আলোরজন্য সাক্ষাৎকার। প্রথম আলোরসহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক আনিসুল হক প্রশ্ন করছেন, এরই ফাঁকে সামনে থাকা একজন নক্ষত্রকে দেখতে পেলাম।

প্রথম আলোকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার এক ফাঁকে লেখক অরুন্ধতী রায়। ছবি: তৌহিদা শিরোপা

চিরচেনা ধূসর কাঁচাপাকা কোঁকড়া চুল, চুলে দুটি গোলাপ ফুলের ক্লিপ। বাহ্‌ খুব সুন্দর তো ক্লিপগুলো। বেশ লাজুক মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ। এগুলো আমার খুব প্রিয়।’ কাজল টানা চোখ, নাকের ডান দিকে ছোট্ট একটি পাথর বসানো নাকফুল, কানে পাথরের দুল, দুই হাতে এক গোছা রুপার ও অক্সিডাইজড চুড়ি। হালকা শ্যাওলা রঙের সুতির কামিজ ও স্কার্ফে স্মার্ট লুকটা ফুটে উঠেছে। এমনই তো তিনি।

অরুন্ধতী রায়কে নিয়ে এলে ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদ করেছিল। আমার প্রশ্ন, ‘মানুষ আপনাকে “সিরিয়াস মানুষ” হিসেবে দেখতে পছন্দ করে। এলে তো সিরিয়াস ম্যাগাজিন না, লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন।’

বেশ একচোট হেসে নিলেন। ‘কে বলেছে আমি সিরিয়াস মানুষ। এলেতে আমাকে দেখার পর অনেক মানুষের ভিমরি খাওয়ার অবস্থা। আমি তো এ জন্যই ওদের বলেছি একটা লাইন লিখে দিতে— “অ্যাই এম অন দ্য এ লিস্ট অব অ্যান্টি ন্যাশনালস।”’ 

অরুন্ধতী মনে করেন, সিরিয়াস কাজ করার সঙ্গে স্টাইলিশ না হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।

সব সময় সোজাসাপটা কথা বলেন। কেউ কেউ তাঁকে বিতর্কিত তকমা দেন, নেতিবাচক মন্তব্য করেন তাঁর কাজ, তাঁর কর্ম, তাঁর লেখনী নিয়ে। এসব কীভাবে সামলান, ব্যাখ্যা কী? তাঁর ভাষায়, ‘সবাই আমাকে পছন্দ করবে এমনটা ভাবা ঠিক না। আমার কোনো জিনিস কারও পছন্দ হবে, কোনো জিনিস হবে না। আর আমি বিতর্কিত না। বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে আমি লিখি। বিতর্ক আমি তৈরি করি না।

এলে ম্যাগাজিনের সেই প্রচ্ছদ

দিল্লির বাড়িতে একাই থাকেন অরুন্ধতী। লেখার চরিত্রগুলো সারাক্ষণ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এর বাইরে আরও দুজন থাকে এ বাড়িতে—বেগম ফিলদি জান ও মাটি কে লাল, অরুন্ধতীর দুই পোষা কুকুর। ওদের বিষয়ে জানতে আগ্রহী এ কথা শুনে বেশ নড়েচড়ে বসলেন। ‘আপনি জানেন ওদের কথা!’ বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলতে থাকেন কীভাবে পেয়েছিলেন এই দুজনকে। একদম ছানা অবস্থায় হাঁটছিল বাড়ির পাশে, তখন পেয়েছি ওদের। ওরা কিন্তু এখন বেশ বড় হয়েছে (হাত দিয়ে উচ্চতাও দেখান)।
আপনি কি প্রতিদিন হাঁটেন? এক সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, কঠিন ব্যায়াম করেন আপনি।

‘হা হা হা। আসলে সত্যি কথা বলি, ছোটবেলায় আমার অতিরিক্ত শক্তি (এনার্জি) ছিল। তখন কী করব বুঝে উঠতে পারতাম না। মাকে বিরক্ত করতাম। তখন মা বলতেন, ঘুমানোর আগে কয়েক চক্কর দিয়ে আসো, এনার্জি কমানোর জন্য। কয়েক শ মাইল হাঁটার অভ্যাস আমার তখন থেকে হয়েছে। আর স্থাপত্য পড়ার সময় টাকার জন্য অ্যাথলেটিকস প্রশিক্ষণও দিতাম। এখন অবশ্য জিমে যাই, ইয়োগা, অন্য ব্যায়াম করি।’

এত যখন স্বাস্থ্যসচেতন তাহলে কী খেতে পছন্দ করেন? আচার। এ ছাড়া মালায়লাম খাবার লাল চালের পোলাও ও মুরগির মাংস। এটা সবচেয়ে প্রিয় খাবার।

অরুন্ধতী রায় তাঁর দ্য গড অব স্মল থিংস বইটি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর মা ও তাঁর ভাইকে। দুই বছর বয়সে বাবার সঙ্গে মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। পরে মা ছোট অরুন্ধতী ও তাঁর ভাইকে নিয়ে কেরালায় ফিরে আসেন। দুই সন্তান নিয়ে মায়ের সংগ্রাম শুরু হয়। নিজেকে সাহসী বলতে চান না অরুন্ধতী। কিন্তু অনুপ্রেরণা বা জীবনকে অন্যভাবে দেখাটা মনে হয় তখন থেকেই তাঁর শুরু হয়েছিল। ‘আমার মা একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু তাঁর ভাবনা, ছোট ছোট কাজ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় কত অসাধারণ তিনি। অতুলনীয়।’

মা এখন দিব্যি বেঁচে আছেন, তাঁর মতো করে কাজ করে যাচ্ছেন। আর অরুন্ধতীর অন্যতম ভালো বন্ধু হলেন তাঁর বড় ভাই। তিনিও কেরালায় থাকেন।

নিজের পোষা প্রাণী মাটি কে লালের সঙ্গে অরুন্ধতী রায়। ছবি: আলোকচিত্রী শহিদুল আলম/দৃক

লেখক অরুন্ধতী লেখাপড়া করেছেন স্থাপত্য নিয়ে। যখন তিনি স্থাপত্য নিয়ে পড়ছিলেন, সারাক্ষণ শুনতেন বিটলস। সেই থেকে বিটলস বিশেষ করে জন লেনন তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সংগীতশিল্পী। জন লেনন শোনেন না এমন কোনো দিন তাঁর যায় না। দুষ্টু মিষ্টি হাসি দিয়ে বলেন, ‘আই লাভ জন লেনন। ইন লাভও বলা যেতে পারে। সে যা কিছু করে, যেদিকে তাকায় সব, মানে সব আমার ভালো লাগে।’

শিশুর মতো সরলতা প্রকাশ পেয়ে যায় বিশ্বের অন্যতম সেরা এই লেখকের অভিব্যক্তিতে। সুখ বলতে কী বোঝেন তিনি। দ্য মিনিস্ট্র অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস নাড়াচাড়া করতে করতে বলেন, সুখ হলো মনের একধরনের অবস্থা। সব সময় একই রকম থাকে না। তাই বলে সারাক্ষণ দুঃখে থাকারও কিছু নেই।

ফিরে গেলাম তাঁর ঢাকায় আসার কারণে। ছবিমেলা, বন্ধু আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে নিয়ে কিছু বলতে বললাম। ‘ছবিমেলায় এর আগে অনেকবার আসতে বলেছে শহিদুল। আসা হয় না। এবার প্রথমবারের মতো ঢাকায় এলাম। শহিদুলের এই ছবি মেলার উদ্যোগকে শুধু একটি উৎসবের মধ্যে আটকে রাখতে নারাজ আমি। শহিদুল একটা প্রজন্ম তৈরি করেছে, করছে যারা শিল্প নিয়ে ভাবছে। কাজ করছে। এই উদ্যোগকে সত্যিই সাধুবাদ জানাতে হবে। আর আমি পৃষ্ঠপোষক থাকে, এমন অনুষ্ঠানে যাই না। শহিদুল যখন বলল, কোনো করপোরেট পৃষ্ঠপোষকতা নেই, তখন আসতে রাজি হয়েছি।’

অনবদ্য আড্ডা চলছেই। অরুন্ধতী রায়ের চোখমুখের উজ্জ্বলতার প্রকাশ দেখে মনে হলো, সময়টা তাঁর ভালো কেটেছে। আসলেই যে ভালো লেগেছে—তাঁর বন্ধু সোহিনী আসার পর বললেন, ‘ওরা দুজন আমাকে আমার থেকেও বেশি চেনে। সবকিছু জানে তারা।’

তাঁর বিনয়, আন্তরিকতা এবং অন্যকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা বলে দেয় কেন তিনি এত লেখকের মধ্যে অরুন্ধতী নামের তারা হয়ে আছেন।