অভিযাত্রিক ইমতিয়াজ

সে রাতে এক নিমেষে পুড়ে ছারখার হয়েছিল আনারুল ইসলামের স্বপ্ন। ছাই হয়ে গিয়েছিল তিলে তিলে গড়ে তোলা সমুদয় সঞ্চয়। গত ১৬ আগস্ট ঢাকার মিরপুর ৭ নম্বরের চলন্তিকা মোড়ের কাছের একটি বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অসংখ্য ব্যক্তি যে ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাঁদেরই একজন আনারুল, পেশায় রিকশাচালক।

২৩ সেপ্টেম্বর তাঁর জীবনের দুর্বিষহ রাতের কথা বলতে গিয়ে যেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন, তেমনি চকচকে নতুন রিকশার চালকের আসনে বসে আনন্দের হাসিও হাসলেন। সেই হাসিতে মিশে থাকল আহমেদ ইমতিয়াজ নামের তাঁর পাশে দাঁড়ানো তরুণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা। আনারুলের কথাতেও ফুটে উঠল তা, ‘গায়ের কাপড় ছাড়া কিছুই নিতে পারি নাই সেদিন। বউ-বাচ্চা নিয়ে খুব অসহায় হয়ে পড়ছিলাম। এরপর অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশনে রিকশার আবেদন করছিলাম। তারা আমাকে এটা কিনে দিছে। এখন আয়ের সবটাই আমার।’

অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশনের সহায়তায় নিজের নৌকা কিনেছেন একজন। ছবি: সংগৃহীত

আনারুলের আনন্দের ছটা আহমেদ ইমতিয়াজকে ছুঁয়ে যায় যেন। অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশন আর ইমতিয়াজ যে মিলেমিশে একাকার। ২০১০ সালের কথা। আহমেদ ইমতিয়াজ তখন ঢাকার সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। মিরপুরের বাসা থেকে কলেজে যাতায়াত করেন। আসা-যাওয়ার পথে কত ঘটনাই তো ঘটে। একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে বাসে এক শিশুকে দেখেন পত্রিকা বিক্রি করতে। তাঁর মনে হলো, এই ছেলেটা তো এখন স্কুলে পড়তে পারত। মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, কেন পড়তে পারছে না?

ততক্ষণে আমরা পল্লবীতে অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশনের অফিসে এসে বসেছি। ইমতিয়াজ যোগ করেন, ‘ছেলেটির সঙ্গে একই বাসে পল্লবীতে নামি। নেমে দেখি, ছেলেটার বাবা একটা চা-পানের দোকানি। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ছেলেকে কেন স্কুলে দিচ্ছেন না?’ ইমতিয়াজের প্রশ্নে সেই বাবার উত্তর ছিল—দারিদ্র্য। তবে ইমতিয়াজ রাজি করিয়ে আসেন, রাসেল নামের সেই ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করালে তাঁর দোকানে আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।

কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ইমতিয়াজ কীভাবে করবেন সহায়তা। পরদিন কলেজে গিয়ে তিন বন্ধু ইফতি আহমেদ, জামিল আযহার, মিনহাজ আহমেদকে ঘটনাটি জানান ইমতিয়াজ। সবাই রাজি হলেন নিজেদের জমানো টাকা থেকে সহায়তা করার। তাঁরা সবাই মিলে পাঁচ হাজার টাকা সহায়তা করেন রাসেলের বাবাকে। রাসেল হকারি বন্ধ করে স্কুলের পথ ধরল।

ইমতিয়াজ বলছিলেন, ‘এক রাসেলকে স্কুলে যাওয়ার সুযোগ করে দিলেও দেখলাম আশপাশে হাজার হাজার রাসেল রয়ে গেছে। তাদের জন্যও কিছু করা উচিত।’

সেই কিছু করার অভিপ্রায় থেকেই শুরু হয় অভিযাত্রিকের যাত্রা। ৯ বছরের অভিযাত্রায় অভিযাত্রিক এখন অনেক মানুষের অবলম্বন। ২০১৪ সালে ফাউন্ডেশন হিসেবে নিবন্ধিত হয় সংগঠনটি। কাজের ব্যাপ্তি বাড়ে, নানা প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে চলতে থাকে। ২০১৩ সালে মিরপুরে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য যে স্কুল চালু করে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল, সেই স্কুলের সংখ্যা এখন তিন। অন্য দুটি স্কুল ঢাকার রায়েরবাজার এবং পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে।

ইমতিয়াজ বলে যান, ‘একটি প্রভাতি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ঘরে আমরা প্রথম স্কুলটা শুরু করি। বিনা ভাড়ার সেই স্কুলে শিক্ষকও ছিলাম বন্ধুরাই। এখন তিনটি স্কুলে ৪০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। রায়েরবাজার আর রাঙ্গাবালীর স্কুলটিতে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হলেও মিরপুরের স্কুলটিতে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। সব মিলে এখন আমাদের ২০ জন শিক্ষক নিয়মিত কাজ করেন।’

স্কুলের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য ১৫০ জন দাতা প্রতি মাসে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে দেন। এই টাকায় শিক্ষার্থীদের পোশাক, শিক্ষা উপকরণ আর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। ব্যবস্থা করা হয় শিক্ষকদের সম্মানীর।

আহমেদ ইমতিয়াজ। ছবি: খালেদ সরকার

সক্ষম ৪৫২

অভিযাত্রিক স্কুলে যে শিশুরা পড়তে আসত, তাদের অধিকাংশই একসময় ঝরে পড়ত। পরিবারের অসচ্ছলতার জন্যই এই শিশুরা ‘শ্রমিক’ বনে যেত। তাদের স্কুলমুখী করার ভাবনা থেকেই ২০১৬ সালে সক্ষম প্রকল্পের শুরু।

ইমতিয়াজ বলেন, ‘আমরা এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করি মানুষের জাকাতের অর্থ আর কিছু প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতার তহবিলের সহায়তা দিয়ে। শুরুতে শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে গিয়ে বোঝাতাম, শত শত মানুষকে শাড়ি-লুঙ্গি দেওয়ার চেয়ে একজন মানুষকে স্বাবলম্বী করলে তিনি আর মানুষের কাছে হাত পাতবেন না।’

অভিযাত্রিককে পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি সক্ষম প্রকল্পটি সমন্বয় করেন আমরাই বাংলাদেশের সহপ্রতিষ্ঠাতা আরিফ আর হোসেন। সেই প্রকল্প থেকে কাউকে কিনে দেওয়া হয়েছে সেলাই মেশিন, কাউকে দেওয়া হয়েছে দোকান করার অর্থ, কাউকে করা হয়েছে মাছ চাষে সহায়তা, কাউকে আবার দেওয়া হয়েছে জমি চাষের জন্য ট্রাক্টর—প্রকল্পের ২৩টি বিষয়ে মানুষকে স্বাবলম্বী করার কাজ এগিয়ে চলেছে। ৩ বছরে দেশের ৭টি জেলায় ৪৫২ জন মানুষকে তাঁরা সহায়তা দিয়েছেন।

এমনই সাহায্যপ্রাপ্ত একজন মফিদুল মিয়া। বাড়ি শরীয়তপুর জেলায়। ভাড়া করা ভ্যানে একসময় সবজি বিক্রি করতেন। কখনো বাড়ি বদলের সময় মালামাল টানতেন। আয়ের বড় অংশ চলে যেত ভ্যানমালিকের হাতে। সক্ষম প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁকে একটি ভ্যান কিনে দেওয়া হয়েছে, সঙ্গে দেওয়া হয়েছে সবজি ব্যবসার পুঁজি। আর তাঁর স্ত্রীকে কিনে দেওয়া হয়েছে সেলাই মেশিন।

মফিদুল মিয়াকে পাওয়া গেল পল্লবীতেই। তিনি বলছিলেন, ‘এতে খুব উপকার হয়েছে আমাদের। মেয়ের বিয়ের জন্য কিছু ঋণ করেছিলাম, সাহায্য পাওয়ার এক বছরের মধ্যে আমরা ঋণের ৫০ হাজার টাকা শোধ করেছি। গ্রামে অল্প জমিও কিনেছি।’ এখন তিনি স্বপ্ন দেখেন আবার একদিন গ্রামে ফিরে যাবেন, নিজের কেনা জমিতে ঘর ওঠাবেন, নাড়িপোঁতা গ্রামে বসবাস করবেন।

সক্ষমের মতো ২০১৭ সাল থেকে অভিযাত্রিক চালু করেছে স্বাস্থ্যসেবা। এর মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। এভাবেই অভিযাত্রিকের কাজের ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে ৩২ জেলায়। সেই সঙ্গে বাড়ছে ইমতিয়াজ আহমেদের স্বপ্ন। ২০১৮ সালে তিনি আহ্​সানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। তিনি বলছিলেন, ‘শুরু থেকেই ভেবেছি, মানুষের পাশে দাঁড়াতে হলে সাংগঠনিকভাবে এগোতে হবে। অভিযাত্রিক আজ প্রতিষ্ঠানে রূপ পেয়েছে। ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম পরিচালনায় আমরা অনুদানের ৫ শতাংশ ব্যয় করি। প্রকল্পগুলো সঠিকভাবে চলছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করা। নতুন নতুন প্রকল্প চালু করাসহ আনুষঙ্গিক কাজে এটা ব্যয় হয়। খরচের সব হিসাব দাতাদের দেওয়া হয়। সাহায্যপ্রার্থীদের সঙ্গেও তাঁরা চাইলে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন।’

গল্পে গল্পে অভিযাত্রিক নিয়ে নানা স্বপ্নের কথা শোনান ইমতিয়াজ। তাঁর সেই স্বপ্ন কথায় ফুটে ওঠে—সুন্দর একটি বাংলাদেশের হাসিখুশি মানুষের মুখচ্ছবি।