অনিন্দ্যসুন্দর আন্ধারমানিক

রহস্যঘেরা আন্ধারমানিক। ছবি: সংগৃহীত
রহস্যঘেরা আন্ধারমানিক। ছবি: সংগৃহীত

নৌকায় যখন বড়মদকের পথ ধরলাম, ঘড়িতে সময় সাড়ে সাতটা। নভেম্বরের সকাল। আকাশে ভাসছিল পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। যার কিছুটা মিশেছে পাহাড়ের মাথায়। সাঙ্গু নদের বুক চিরে ইঞ্জিন নৌকা এগিয়ে চলল, পেছনে পড়ে রইল থানচি উপজেলার রেমাক্রি।
আগের রাতে বান্দরবান থেকে রেমাক্রিতে এসে আস্তানা পেতেছিলাম। থানচি থেকে রেমাক্রি পর্যন্ত চেনা পথ। কিন্তু সামনের দিকে যতই এগিয়ে যাচ্ছি, ততই ঘন হয়ে আসছিল নদীর দুই ধারের পাহাড়ি বন। সাক্ষী হচ্ছিলাম অচেনা সৌন্দর্যের। সে সৌন্দর্য মোহিত করেছে দলের প্রত্যেককেই।
নদীর দুই ধারের বুনো সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে পৌঁছালাম বড়মদকে। সকাল ১০টা তখন। দুই নৌকায় আমরা ছিলাম ১১ জন। একে একে সবাই নেমে পড়লাম। এখানে বড় একটা পাহাড়ি বাজার আছে, আর আছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ক্যাম্প।
থানচি থেকে অনুমতি মিলেছিল এই বড়মদক পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু আমাদের মনের গন্তব্য তো আন্ধারমানিক! সে পথে যেতে চাইলে বিজিবি ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি নিতেই ক্যাম্পে গেলাম।
পাহাড়ের ওপরে বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ ফুট উচ্চতায় সে ক্যাম্প। পৌঁছাতেই অনেকের গলদঘর্ম অবস্থা। পরিচিত হলাম ক্যাম্প কমান্ডারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, বড়মোদক থেকে সামনে এগোতে হলে তারা সর্বোচ্চ সতর্কতার মধ্যে পথ চলেন। তিনি আরও নানা প্রতিবন্ধকতার কথা শোনালেন। তাঁর কথা শুনে দলের কয়েকজন তো ভয়ে জড়সড়! আলাপের মধ্যেই সুখবরটাও তিনি শোনালেন। আমাদের আন্ধারমানিক পর্যন্ত যেতে দেওয়া হবে। তবে সঙ্গে থাকবে বিজিবির গাইড, আর মেনে চলতে হবে কিছু নির্দেশনা।

নৌকা চলল উজানপানে
একবাক্যে সব শর্তে সম্মতি দিলাম আমরা। ফের সাঙ্গুর উজানপানে চলতে শুরু করল ইঞ্জিন নৌকা। আবারও সেই চোখ জুড়িয়ে দেওয়া সবুজ, বিশাল পাহাড় মেলে ধরে আছে রহস্যময়তা, নীরব পাথরের গায়ে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসা ইঞ্জিন নৌকার শব্দ। চারদিকে আমরা ছাড়া আর কোনো জনমানুষ নেই। কেমন একটা গা ছমছমে অনুভূতি।
প্রায় দেড় ঘণ্টা পর মাঝি একটা টানেলের মতো জায়গায় নৌকা থামালেন। ইঞ্জিনের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই জানালেন, ‘এহান থাইকা আন্ধারমানিকে যাওয়ার পথ শুরু।’
নীরবতা জেঁকে বসেছে যেন। ভরদুপুরে মনে হচ্ছিল আসন্ন সন্ধ্যা। নীরব প্রকৃতির ঘুম ভাঙাতে সময়ে সময়ে ঝিঁঝি পোকাদের আওয়াজ, নিয়ম মেনে নাম না–জানা পাখির কিচিরমিচির, তার সঙ্গে টানেলের মুখ থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসা অদ্ভুত শব্দ—সব শব্দ মিশে ভয়–জাগানিয়া এক মুহূর্ত।

থানচি থেকে রেমাক্রির পথে যাত্রা।

তবু আমাদের পথচলা থামল না। শুরুতে গোড়ালি পর্যন্ত পানি ছিল, যতই সামনের দিকে এগোলাম, পানির পরিমাণ বাড়তে থাকল। সামনের বাঁক পেরোতেই খুব সুন্দর একটা ঝরনার দেখা মিলল। সবার মুগ্ধতা দেখে গাইড জানালেন, এ রকম অসংখ্য ঝরনার দেখা মিলবে সামনেই। ঠিক তখনই লম্বা একটা সাপের সঙ্গে সাক্ষাৎ। এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাচ্ছে আপনমনে। সাপ দেখে অনেকের তো পা আটকে গেল।
মাঝি তখন সৌন্দর্যের লোভ দেখালেন। বললেন, সামনেই তো সেই মনমাতানো ঝরনা। প্রায় দশ মিনিট যাওয়ার পর সত্যিই সবার চোখজোড়া ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। নাম না–জানা সেই পাহাড়ি ঝরনা নারীর চুলের বেণির মতো পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে।
বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম, আর কিছু থাকল মনের ক্যামেরায়, যেমনটা এখনো আছে আন্ধারমানিক।

যাবেন যেভাবে
ঢাকা থেকে বাসে যেতে হবে বান্দরবান। শ্যামলী, এস আলম, ইউনিকসহ বিভিন্ন পরিবহনের বাস পাওয়া যায়। বান্দরবান শহর থেকে চান্দের গাড়ি, জিপ কিংবা বাসে করে যেতে পারেন থানচি শহরে। থানচির বিজিবি ক্যাম্পে গিয়ে অনুমতি নিতে হবে। সে অনুমতি পাওয়া সাপেক্ষেই রেমাক্রি থেকে ইঞ্জিন নৌকায় করে বড়মোদক পার হয়ে আন্ধারমানিকে যেতে হয়। পথটা যেহেতু নৌকায় যেতে হয়, তাই থানচি থেকে লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নিতে ভুলবেন না।