প্রথম আলোতে প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে রম্য পাতা—কথাcom। লেখা পাঠাতে পারেন আপনিও। ইমেইল: kothacom@prothomalo.com
ঢাকার বেসরকারি চাকরিজীবী উৎসুক সাহেব। ইহকাল-পরকাল, পার্থিব ও অপার্থিব তাবৎ বিষয়ে তাঁর তুমুল আগ্রহ। অদেখাকে দেখা আর অজানাকে জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁর। তো জীবনটাকে অন্যভাবে দেখার উদ্দেশ্য নিয়েই একদিন সকালে অফিসের পথ ধরলেন উৎসুক—মোবাইল ফোন ছাড়া।
পরীক্ষামূলকভাবে উৎসুক দেখতে চান, মোবাইল ছাড়া একটা দিন কেমন কাটে। মগবাজার থেকে বাসে উঠলেন তিনি। গন্তব্য কারওয়ান বাজার। বাস মগবাজার মোড় পার হতে না হতেই উৎসুক সাহেব প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে লাফিয়ে উঠলেন। আঁতকে উঠে বললেন, ‘আমার মোবাইল!’ পরক্ষণেই তাঁর মনে পড়ল, ইচ্ছা করেই তিনি বাড়িতে মোবাইল রেখে এসেছেন। তবে ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে।
বাসে উৎসুক সাহেব একজনই, তবে উৎসুক লোকের অভাব ছিল না। আশপাশ থেকে নানাজন নানা কথা বলতে শুরু করল।
‘মানিব্যাগ আছে, না ওইটাও গেছে?’
‘ফোনে একটা ফোন দেন, ভাই!’
‘বমি পার্টির কাম না তো?’
উৎসুক সাহেব ভেবেছিলেন, চুপচাপ ব্যাপারটা চেপে যাবেন। কিন্তু দেখা গেল বাসযাত্রীদের উৎসাহের কমতি নেই। রাস্তার এক পাশে বাস দাঁড় করানো হলো। লাগিয়ে দেওয়া হলো দরজা। নেতা গোছের একজন দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। বললেন, ‘কোনো টেনশন নিয়েন না, ভাই। আইজকা চোরের নিস্তার নাই। সবার পকেট চেক করা হবে। ওই ড্রাইভার, এদিকে আসো। তোমার পকেট দিয়া শুরু…।’
মোবাইল যদি চুরি হয়েও থাকে, সন্দেহভাজন হিসেবে ড্রাইভারের নাম সবার পরে আসার কথা। বেচারা তো আগাগোড়াই বসে ছিলেন ড্রাইভিং সিটে। তাঁকে দিয়েই কেন খোঁজ দ্য সার্চ কার্যক্রম শুরু হলো কে জানে!
একে একে সবার পকেট চেক করতে লাগলেন ভলান্টিয়ার ভাইটি। এমনকি যাদের পকেট নাই, পরনে লুঙ্গি, তাদেরও লুঙ্গির গিঁট চেক করা হলো। কারও পকেটেই যখন উৎসুক সাহেবের মোবাইলটি পাওয়া গেল না, তখন বাসযাত্রীদের মধ্যে বিরক্ত একজন বলে উঠলেন, ‘এই যে ভাই…সবার পকেট চেক করতেসেন ভালো কথা। আপনার পকেট তো চেক করা হইলো না।’
‘হ হ, তাই তো।’
‘ঠিক কথা।’
রব উঠল। একরকম জোরজবরদস্তি করেই ভলান্টিয়ার ভাইটিরও পকেট চেক করা হলো। পেছনের দুই পকেট থেকে বেরিয়ে এল দুইটা মানিব্যাগ।
‘মানুষ একটা। মানিব্যাগ দুইটা ক্যান? ওই ধর ধর…’
লেগে গেল বিরাট হট্টগোল। উৎসুক সাহেবের হঠাৎই মনে হলো, মারামারির একটা ভিডিও তো করা দরকার। চোখের সামনে একটা মারামারি হবে অথচ ভিডিও করা হবে না, এটা তো হতেই পারে না! পকেটে হাত দিয়েই আবার আঁতকে উঠলেন তিনি, ‘আমার মোবাইল!’
যাহোক, বাস থেকে নেমে হাঁটা ধরলেন উৎসুক সাহেব। ১৫ মিনিটের হাঁটাপথে আরও কয়েকবার তাঁকে ‘আমার মোবাইল’ বলে আঁতকে উঠতে দেখা গেল। উৎসুক সাহেব ঠিক করলেন, যতবার তিনি নিজের মোবাইলখানা মিস করবেন, কাগজে লিখে রাখবেন।
২.
তা বাড়ি ফেরার পর স্কোর কত হলো?
মোবাইল: ৭৬
ফেসবুক: ৮৪
অর্থাৎ দিনের মধ্যে যতবার মোবাইলকে মিস করেছেন, তার চেয়ে বেশি মিস করেছেন ফেসবুককে। ভেবেছিলেন বাসায় গিয়েই ছুটে যাবেন প্রিয় মোবাইলটার দিকে।
কিন্তু ঘরে ঢুকে স্ত্রীর চিৎকারে পিলে চমকে গেল।
‘নাদিয়া কে?’
থতমত খেয়ে গেলেন উৎসুক।
‘বলো নাদিয়া কে?’
দ্বিতীয়বার ধমক খেয়ে মনে পড়ল সেই কলেজজীবনের নাদিয়ার কথা। একসঙ্গে রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর প্রেমময় সব স্মৃতি! আহা! কিন্তু সে তো প্রায় ১০ বছর আগের কথা।
‘আহা হয়েছে কী? খুলে বলো তো।’ উৎসুক বলেন।
‘তোমার প্রেমিকা নাদিয়া ফোন করেছিল। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। তোমার কথা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। এই নাও তোমার মোবাইল, নাদিয়াকে কল করে ওকে দুশ্চিন্তামুক্ত করো।’
হায় কপাল! মনে মনে ভাবলেন উৎসুক। গত ১০ বছরে নাদিয়া একটিবারের জন্য কল করেনি। উৎসুক হাজারবার ফোন করেছেন, রিসিভও করেনি। আর আজকেই কিনা ওর কল করা লাগল!
কিন্তু সত্যিই কি নাদিয়া কল করেছিল?
হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিতে গেলেন উৎসুক, ‘কই দেখি?’
ফোনটা হাতে নেওয়ার আগে স্ত্রী হাত সরিয়ে ফেললেন। ‘বা বা! সারা দিন প্রিয়তমার সঙ্গে কথা হয়নি। এখন মন খুব আনচান করছে, তাই না?’
রাগে-দুঃখে ফোনটা এক আছাড় মারলেন স্ত্রী।
একই দিনে ৭৭তমবারের মতো চিৎকার করে উঠলেন উৎসুক সাহেব, ‘আমার মোবাইল!’ তবে এবার আর মনের ভুলে নয়।
৩.
মানবমন বড়ই বিচিত্র।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগপর্যন্ত উৎসুক সাহেব তাঁর মোবাইলের জন্য কাতর হয়ে থাকলেন।
অথচ ঘুমের ঘোরে ‘মোবাইল’ নয়, বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘নাদিয়া! নাদিয়া!’
স্ত্রী পাশেই ছিলেন।
পরদিন ঘুম থেকে ওঠার পর উৎসুকের কী হয়েছিল, সে খবর আমরা আর নিতে পারিনি।