রম্যগল্প

‘আমাকে কেউ গোনায় ধরল না’

ছবি: প্রথম আলো, অলংকরণ: আরাফাত করিম

সকালে পাড়ার চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়াল আক্কাস আলী। ফ্রিল্যান্স ডিজাইনার আক্কাস খুব হিসাব করে কাজ করে। কাজটা কেমন, কত ডলারের কাজ, কেমন সময় লাগবে—এসব গুনে গুনে কাজের আবেদন করলেও জীবনে গণনা বিষয়টা তার সঙ্গে প্রহসন করে প্রতিনিয়ত।

দোকানে একজনের হাতে পত্রিকার পাতায় জনশুমারির খবর দেখতেই আক্কাসের মনে হলো, তার কাটা ঘায়ে কে যেন লবণ ছিটিয়ে দিল। ভাবল, ‘জনশুমারির সময় আমার বাসায় তো কেউ আসে নাই। তাহলে এবারও আমাকে কেউ গোনায় ধরল না!’ আক্কাস দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে পরক্ষণেই ভাবল, ‘নাকি আমাকে গুনতে আসার সময় বাসার বাইরে ছিলাম?’

যা-ই হোক, জনশুমারিতে নিজের অস্তিত্ব না থাকায় আক্কাস আলী একটা কথাই বিড়বিড় করতে লাগল, ‘আসকে আমার মন বালো নেই!’

তবে এই যে গোনায় না ধরা, এটা কিন্তু আক্কাস আলীর গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। একটা সময় ছিল, যখন এসবে ভীষণ মন খারাপ হতো। মনে পড়ল, তাকে তো ছোটবেলা থেকেই কেউ গোনায় ধরত না। সবাই বলত, ‘তুই তো দুধভাত!’

হয়তো কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে পরিবারের সবাই। একে একে সবাইকে গুনলেও আক্কাসকে কেউ গুনত না। ব্যাপার কী? গাড়িতে উঁকি মারলেই আক্কাস বুঝে যেত, গাড়িতে তার জন্য কোনো সিট নেই। খেলার মাঠেও তা-ই। দল গঠনের জন্য আরেকজনকে দরকার, আক্কাস এগিয়ে গেল। আর ঠিক তখনই পেছন থেকে ছুটে এল বিল্টু নাহয় কামাল। দলনেতা ওদেরই বেছে নিল। পাড়ার ক্লাবেও তা-ই। দলবলে একটা কাজ করবে, আক্কাসকে ডেকে দায়িত্বও দেওয়া হলো, কিন্তু এক বড় ভাই এসে বলল, ‘আরে না, এটা বাবলুরে দে।’ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হাটে-মাঠে-ঘাটে—সবখানে। স্কুলেও একই ব্যাপার। মেয়ে সহপাঠীরা অন্যদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেও আক্কাসকে গোনায় ধরত না। আরও বড় হলে কলেজে ভর্তি হলো। সেখানেও ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়’।

কলেজে আক্কাসদের বাণিজ্যিক ভূগোল পড়াতেন কাশেম স্যার। একদিন আক্কাসকে ডেকে বললেন, ‘আদমশুমারির (তখন জনশুমারিকে আদমশুমারি বলা হতো) কাজ করবি?’

আক্কাস কিছু বোঝার আগেই স্যার সবকিছু বিস্তারিত বললেন। অল্প কদিন কাজ করে কিছু টাকা পাওয়া যাবে। উত্তম প্রস্তাব। স্যারের কথায় একবাক্যে রাজি হয়ে গেল আক্কাস। প্রশিক্ষণ শেষে পাশের গ্রামে গেল মানুষ গুনতে। একটা বাড়িতে বসে বাড়ির কর্তাকে প্রশ্ন করল, ‘আপনার ছেলে-মেয়ে আছে?’

‘জে, আছে।’

‘কয়টা?’

‘তিনটা। বড়জন মেয়ে, মেজটা ছেলে আর ছোটটা মেয়ে।’

‘আপনি বিয়ে করছেন?’

এই প্রশ্ন করার পর কী হয়েছিল, তা আর না বললেও চলে। সে যাত্রায় কেউ একজন পানির ছিটা দেওয়ার পর আক্কাসের জ্ঞান ফিরেছিল। তারপরও আক্কাস বুঝতে পারছিল না, তার ভুলটা কোথায়! শুমারিতে অংশ নেওয়া এক বন্ধু বলল, ‘ধুর বেটা, বুঝেশুনে প্রশ্ন করবি না? প্রথমে বিয়েশাদির খবর নিবি। তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়!’

বন্ধুর কথামতো পাশের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির কর্তাকে আক্কাস প্রশ্নটা করল ঘুরিয়ে, ‘আপনি কি বিবাহিত?’

‘জে, না।’

‘আপনার ছেলে-মেয়ে কয়টা?’

আরেক প্রস্থ পানি ছিটানোর পর জ্ঞান ফিরলে এবারও আক্কাস নিজের ভুলটা বুঝতে পারল না! কারণ, আদমশুমারির প্রশিক্ষণে বলা হয়েছে, প্রত্যেকের বৈবাহিক অবস্থা এবং সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করতে হবে। যাহোক, রাগে-দুঃখে শুমারির কাজে ইস্তফা দিয়ে আক্কাস ফিরে এল বাড়িতে। সে যাদের গুনেছিল, তাদের নাম বাদ দিয়ে নতুন করে আরেকজন গুনতে গেল। তার মানে আদমশুমারিতে তার গোনাগুলোও কেউ গোনায় ধরল না!

কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আক্কাস দেখে, প্রথম বর্ষ শেষ হতেই সবাই জোড়ায় জোড়ায় ঘুরছে। আক্কাস দলছুট। কেউ গোনায় ধরে না। ‘হুঁশ ঠিক, মাথা খারাপ’ বলে একটা প্রবাদ আছে। সেই সূত্রমতে পিকনিকে গেলে বা রেস্তোরাঁয় বসলে বিল দেওয়ার আগে ঠিকই তাকে গোনায় ধরত বন্ধুরা। অথবা কোনো বন্ধুর ভাই-বোনের বিয়ে। সবাই মিলে উপহার দেবে। তখন ঠিকই আক্কাসকে গোনায় ধরা হতো। উপহারের মূল্য ভাগ হতো মাথাপ্রতি সমান ভাগে।

পড়াশোনা শেষে অগুনতি চাকরির সাক্ষাৎকার দিল আক্কাস। সবার চাকরি হয়, তার হয় না (প্রতিটা লাইনের পর ‘গোনায় ধরল না’ লিখতে হবে, এমন তো কথা নেই)। আক্কাস বুঝল, অভিজ্ঞতা না থাকলে ফ্রেশারদের গোনায় ধরে না কোনো চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান। আর তাই সে এখন মনোযোগ ঢেলে দিয়েছে আউটসোর্সিংয়ে।

এ বছরের শুরুর দিকে নোয়াখালীর দুই রাজনৈতিক নেতার মধ্যে (যাঁরা সম্পর্কে সহোদর) ব্যাপক কোন্দল দেখা দিল। দুই ভাইয়ের খবর সংবাদমাধ্যম প্রচার করতে লাগল ফলাও করে। একদিন পত্রিকা দেখে আক্কাসের চোখ ছানাবড়া। স্থানীয় নেতা তাঁর ভাইয়ের (যিনি জাতীয় নেতা) উদ্দেশে বলেছেন, ‘তারে গোনার টাইম নাই!’

টাইম না থাকলে ভিন্ন কথা। কিন্তু টাইম থাকার পরও যদি কেউ কাউকে গোনায় না ধরে, তাহলে ব্যাপারটা হালকাভাবে নেওয়ার কিছু নেই! যেমনটা হয়েছে আক্কাসের বেলায়।

চায়ের দোকান থেকে ফিরে আক্কাস লোকাল বাসে উঠল। মিরপুরে যেতে হবে। পাশের সিটে বসা লোকটা মুঠোফোনে কী যেন দেখতে দেখতে বলছিল, ‘বুঝলেন, গোনায় না ধরলেই ভালো।’

‘কীভাবে ভালো? একটু বলবেন?’

‘ভাই, গোনায় না ধরলে জনসংখ্যা কম দেখাবে।’

‘হ্যাঁ, তা তো হবেই।’

‘তাহলে মানুষ কমলে মাথাপিছু আয় বাড়বে না?’

‘তা তো বাড়বেই।’

‘লাভটা এইখানেই!’