অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে পুরোনো বার্বি পুতুলগুলো হতে পারে অত্যন্ত বিষাক্ত। জাতীয় জাদুঘরের গবেষণা অধ্যাপক ড. ইভান শাশুয়ার কাছ থেকে জানা গেল, শুরুর দিকের বার্বি পুতুল তৈরির গোপন রসায়ন এবং সময়ের সঙ্গে পুতুলের প্লাস্টিক বিষিয়ে যাওয়ার কারণ ও পুরোনো বার্বি সংরক্ষণের সঠিক উপায়।
চারদিকে হলিউডি সিনেমা ‘বার্বি’র জয়জয়কার। ফলে বার্বি পুতুল নিয়েও নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে তুমুল আগ্রহ। সিনেমাটি দেখার পর অনেকেই হয়তো স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন। ছোটবেলার প্রিয় খেলনাটি হয়তো শোকেস কিংবা ভাঁড়ারঘর থেকে বের করে আনছেন কেউ কেউ। তেমনই একজন আনিকা (ছদ্মনাম), পুরোনো জিনিসপত্র ঘেঁটে প্রায় ১৫ বছর আগের একটা বার্বি পুতুল বের করেছেন। কিন্তু হাতে নিতেই খেয়াল করলেন, পুতুলটির গায়ের ‘সোনার বরন’ গল্পের সেই রাজকন্যার মতো কালচে হয়ে গেছে! তার ওপর কেমন যেন আঠালো ভাব।
আনিকার মতো বছরের পর বছর ধরে যাঁরা ছোটবেলার শখের বার্বি পুতুল কিংবা অন্য কোনো প্লাস্টিকের পুতুল জমিয়ে রেখেছেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো ইতিমধ্যে একই ব্যাপার খেয়াল করেছেন। ভাবছেন, পুরোনো হয়েছে বলেই হয়তো এমন হয়েছে। আবেগের বশে পুতুলগুলো ফেলেও দিতে পারছেন না। অনেকে তো আবার ভবিষ্যতে নিজের সন্তানদের খেলতে দেবেন ভেবে পুরোনো পুতুলগুলো যত্ন করে তুলেও রেখেছেন। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এই পুরোনো, কালচে প্লাস্টিকের পুতুলগুলো হতে পারে অত্যন্ত বিষাক্ত।
২০০০ সালে এর বিষক্রিয়ার যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যেই এসব নিষিদ্ধ। ২০০৭ সাল থেকে তো যেকোনো খেলনা বা তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য তৈরি জিনিসপত্রে প্লাস্টিসাইজার ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
বিষয়টি নিয়ে গত ২৮ জুলাই এক নাতিদীর্ঘ আলোচনা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানভিত্তিক সাপ্তাহিক রেডিও টক শো ‘সায়েন্স ফ্রাইডে’তে। টক শোটি উপস্থাপনা করেছেন আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স (এএএএস)–এর গণমাধ্যমকর্মী চেলসি বুডু। আর বিশেষজ্ঞ বক্তা হিসেবে ছিলেন ডেনমার্কের জাতীয় জাদুঘরের গবেষণা অধ্যাপক ড. ইভান শাশুয়া। চেলসি নিজেও একজন বার্বি–ভক্ত। তবে সিনেমার চেয়ে বার্বি পুতুল তৈরির পেছনের বিজ্ঞান নিয়েই বেশি কৌতূহলী তিনি। দুজনের সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে জানা গেছে বার্বি পুতুল তৈরির গোপন রসায়ন এবং সময়ের সঙ্গে পুতুলের প্লাস্টিক বিষিয়ে যাওয়ার কারণ ও পুরোনো বার্বি সংরক্ষণের সঠিক উপায়।
প্রথম দিকে অর্থাৎ ১৯৫০–এর দশকে বার্বি পুতুল তৈরির উপাদান ছিল সবার অজানা। ইভান শাশুয়া বলেন, ‘কিন্তু এখন আমরা জানি যে বার্বির উপাদান ছিল পিভিসি বা পলিভিনাইল ক্লোরাইড।’ প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিসাইজার দিয়ে পিভিসি নমনীয় করে বার্বির শরীর ও মুখের অংশ তৈরি করা হতো। প্রক্রিয়াটি ব্যাখ্যা করে ইভান জানান, প্লাস্টিসাইজার হচ্ছে একধরনের নমনীয়কারী উপাদান। ১৯৫০ থেকে ২০০০ সালে প্লাস্টিসাইজার হিসেবে ব্যবহৃত হতো নানান ধরনের ফ্যালেট। এসব উপাদান প্লাস্টিক গলিয়ে খুব ভালোভাবে নমনীয় করে ফেলতে পারে। খরচও কম। কিন্তু এই পদ্ধতিতে পুতুলের প্লাস্টিকে অতি বিষাক্ত কিছু উপাদান সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
শুধু বার্বিই নয়, ইউরোপ–আমেরিকায় অন্য সব প্লাস্টিকের পুতুলও একইভাবে তৈরি করা হতো। তবে এখন আর আগের মতো উপাদান দিয়ে বার্বি পুতুল তৈরি হয় না। আজকাল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু বার্বির মুখমণ্ডলের আকার দেওয়ার জন্য প্লাস্টিসাইজারসমৃদ্ধ পিভিসি ব্যবহার করা হয়। আর হাত, পা এবং শরীরের জন্য ব্যবহৃত হয় ভিন্নধর্মী প্লাস্টিক।
বিষাক্ত প্লাস্টিক দিয়ে পুতুল তৈরি করা হলে তা সত্যিই বেশ চিন্তার বিষয়। এটি পরিবেশ, মানুষ এবং পোষা প্রাণীর জন্য ঠিক কতটা ক্ষতিকর? চেলসির এমন প্রশ্নের উত্তরে শাশুয়া বলেন, ফ্যালেট প্লাস্টিসাইজার কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে বেশ লম্বা বিতর্ক আছে। তবে ২০০০ সালে এর বিষক্রিয়ার যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যেই এসব নিষিদ্ধ। ২০০৭ সাল থেকে তো যেকোনো খেলনা বা তিন বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য তৈরি জিনিসপত্রে প্লাস্টিসাইজার ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
শাশুয়া জানান, প্লাস্টিসাইজারসমৃদ্ধ পিভিসি দিয়ে তৈরি বার্বি নতুন অবস্থায় তেমন ক্ষতিকর না হলেও সময়ের সঙ্গে প্লাস্টিক নষ্ট হয়ে বিষাক্ত হয়ে যায়। এর পেছনের মূল কারণ হচ্ছে তাপ। তিনি বলেন, প্লাস্টিকের বার্বি যত সূর্যের আলো এবং অক্সিজেনের সংস্পর্শ পাবে, তত দ্রুত নষ্ট হবে।
আর এ কারণেই জাদুঘরে বছরের পর বছর সংরক্ষণের জন্য পুতুলগুলো প্রায় অন্ধকার ও শীতল ঘরে রাখা হয়। কিন্তু বাসাবাড়িতে তো আর এভাবে পুতুল সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। তাহলে কি ছোটবেলার প্রিয় বার্বি পুতুল আঠালো হয়ে গেলে এবং রঙে পরিবর্তন এলেই ফেলে দিতে হবে? উত্তর হচ্ছে, ‘না’, ফেলেই দিতে হবে এমনটা মানেন না শাশুয়া, ‘ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে ফ্রিজে রেখে আপনার প্রিয় পুতুলটি সংরক্ষণ করতে পারেন। তবে প্লাস্টিক বিষাক্ত হয়ে যাওয়ার কোনো আভাস পেলেই সেই পুতুল শিশুর কাছ থেকে অবশ্যই দূরে রাখতে হবে।’
সূত্র: সায়েন্স ফ্রাইডে