থ্রিলার লেখকের শেষ গল্প

‘এটা কি জ্যাকি ফরস্টারের বাসা?’

শুনেই ভদ্রমহিলা আমার দিকে রাগী চোখে তাকালেন। বয়স ৪৫ কি ৫০ হবে। পরনে মলিন শাড়ি। আঁচল কোমরে গোঁজা। হাতে একটা

লাল বালতি। ‘না!’ বলেই দরজা লাগিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি।

‘আচ্ছা…ঝন্টু সমাদ্দারের বাড়ি তো এটাই?’

‘বললাম তো, এইটা কারও বাড়ি না। এইটা আমার বাড়ি। আপনি যান তো।’

আমাদের দুজনের মধ্যে রীতিমতো দরজা ঠেলাঠেলি শুরু হলো। ‘তাঁর কিছু টাকা ছিল…রয়্যালটির টাকা। তিনি মারা যাওয়ার পর থেকেই তাঁর কাছের মানুষ কাউকে খুঁজছিলাম।’ কথাটা বললাম ভদ্রমহিলার হাতের বালতির দিকে তাকিয়ে। এমন নয় যে বালতিটা আমাদের কথোপকথনের বিষয়। আমি আসলে চোখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যা বলতে পারি না।

ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিলেন। ভেতরে ঢুকে যখন সোফায় বসছি, শুনতে পেলাম, তিনি বিড়বিড় করে বলছেন, ‘মরে গেলে আর কেউই কাছের থাকে না। সবাই দূরের হয়ে যায়।’

ঝন্টু সমাদ্দার লোকটা তাঁর লেখা উপন্যাসগুলোর মতোই রহস্যময়। ২১টি বই বেরিয়েছিল; যত দূর জানি। সবই জ্যাকি ফরস্টারের নামে। সবাই ভাবত, এসব অনুবাদ গল্প। পাতা উল্টে অনুবাদকের নামও খুঁজেছিল কেউ কেউ। কিন্তু লেখক যে আদতে বাংলাদেশি, তিনি যে ওষুধ কোম্পানিতে ছোট একটা চাকরি করতেন—সবই জানাজানি হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর। এর আগে অবশ্য বইগুলো খুব একটা আলোচনায়ও আসেনি।

লেখার ভাষা খুব যে আহামরি ছিল, তা নয়। কিন্তু কাহিনি সত্যিই টানটান রোমাঞ্চে ঠাসা। একবার হাতে নিলে শেষ না করে থামা যায় না।

‘যা বলার তাড়াতাড়ি বলেন। মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাব।’

শুনে কেন যেন মনে হলো, ভদ্রমহিলার বয়স যতটা বেশি ভেবেছি, অতটা নয়। স্বামী মারা গেছেন দুই বছর হলো। বোঝাই যাচ্ছে, সব চাপ এসে পড়েছে তাঁর ওপর। কেন যেন খুব মায়া হলো। সত্যি কথাটা খুলেই বললাম, ‘আসলে আপা…আপনাকে একটা মিথ্যা কথা বলেছি। আমার কাছে কোনো…।’

‘জানি। কারও কাছেই তার টাকা পাওয়ার কথা না। সব জায়গায় আমার খোঁজ নেওয়া শেষ।

কী বলতে আসছেন, জলদি বলেন। আমার সময় নাই।’

কথা বাড়ালাম না। বললাম, ‘আপা, আমি পত্রিকা অফিসে ছোট একটা চাকরি করি। নতুন জয়েন করেছি। খুব চাইছিলাম, আমাদের ঈদসংখ্যায় ঝন্টু ভাইয়ের একটা গল্প ছাপব। এটা আমার একটা ব্যক্তিগত আগ্রহই বলতে পারেন। উনি এত ভালো লিখতেন, অথচ জীবদ্দশায় তাঁর পরিচয়টা কেউ জানল না! গল্পের সঙ্গে আমরা তাঁর সম্পর্কে একটা ফিচারও ছাপতে চাই। যদি আপনি অনুমতি দেন।’

‘ছাপতে চাচ্ছেন, ছাপেন। আমার কাছে কী? আর সবাই ছেপেছে না? যে যার ইচ্ছেমতো লিখে দিয়েছে। আমার সাথে কথা বলার তো কিছু নাই।’

বুঝলাম, তিনি বেশ খেপে আছেন। যথেষ্ট কারণ আছে অবশ্য। ঝন্টু সমাদ্দারের মৃত্যুর পর রয়্যালটির টাকা কিছুই নাকি তাঁর পরিবার পায়নি। ঝন্টু সমাদ্দারই যে জ্যাকি ফরস্টার, এটা তাঁরা প্রমাণ করতে পারেননি।

আবারও বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘আপা, বিশ্বাস করেন, আমার লেখালেখিতে আসার পেছনে আপনার স্বামীর বড় অবদান আছে। কত যে খুঁজেছি ওনাকে। আপনার অবস্থাটা আমি বুঝি। যদি তাঁর একটা অপ্রকাশিত লেখাও দিতে পারেন, আমি হয়তো একটু চেষ্টা করতে পারব। পত্রিকায় ছাপা হওয়া লেখা কিন্তু কোর্টে এভিডেন্স হিসেবে খুব ভালো কাজ করে। প্লিজ…।’

ঝন্টু সমাদ্দারের স্ত্রী মাথা নিচু করে কী যেন ভাবলেন। গটগট করে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। একটু পর ফিরে এলেন একটা ল্যাপটপ হাতে।

‘নেন, ধরেন। ভেতরে কিছু পাবেন কি না, জানি না। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে তো এটা নিয়েই পড়ে থাকত। সারা দিন কী লিখত জানি না।’

‘আপনি ল্যাপটপটা খুলে দেখেন নাই?’

‘খুলতে পারলে তো। পাসওয়ার্ড দেওয়া। শেষ দিকে সে তো পাসওয়ার্ডও মনে রাখতে পারত না। ছোট একটা কাগজে কী সব হাবিজাবি লিখে রেখেছে। দেখেন, কিছু বোঝেন কি না।’

ল্যাপটপটা হাতে নিতে গিয়েই ভেতর থেকে ছোট্ট একটা কাগজ পড়ল। তাতে লেখা—

মৌমাছি চোখে তুমি সাগর দেখেছ

সারি সারি চা–গাছে কুঠার হেনেছ।’

মানে কী এসবের? ল্যাপটপটা অন করার চেষ্টা করলাম। যা বুঝলাম, ৮ ক্যারেক্টারের পাসওয়ার্ড। অদ্ভুত ছড়াটাতেও ৮টি শব্দের নিচে আন্ডারলাইন করা। কিন্তু শব্দ থেকে বর্ণ খুঁজে বের করব কী করে!

ধাঁধার উত্তর

উল্টো করে দেখুন