অফিস শেষ করে বাসায় ফিরতে না–ফিরতেই বউ বলল, ‘মরিচ এনেছ?’
আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। লাঞ্চের সময় বউ ফোনে পইপই করে বলে দিয়েছিল, মরিচ আনতে। আমিও তখন ‘আচ্ছা আচ্ছা’ বলে কথা দিয়েছিলাম—ফেরার সময় কারওয়ান বাজার থেকে ঝাল দেখে মরিচ কিনে আনব। এখন বেমালুম ভুলে বসে আছি। এ থেকে মুক্তির উপায় কী?
মানুষ দেখে শেখে। আমিও চারদিক দেখেই শিখছি। ফলে মরিচ ইস্যুটা এখন ঢাকতে হবে অন্য কোনো ইস্যু দিয়ে। বউয়ের দিকে তাকিয়ে সরল মুখে বললাম, ‘মরিচ তো আনতেই গিয়েছিলাম...কিন্তু একটা ঘটনা ঘটে গেল!’
: কী ঘটনা?
: দেখা হয়ে গেল শিহাবের সঙ্গে।
: শিহাবের সঙ্গে দেখা হয়েছে তো কী হয়েছে! সে কি বলল মরিচ কেনা যাবে না?
: তা বলবে কেন?
: তাহলে?
তাই তো, তাহলে? কিছু একটা বানাতে হবে। শিহাব ইস্যু দিয়ে মনে হচ্ছে পার পাওয়া যাবে না। বললাম, ‘আরে, আর কী বলব, শোনো...শিহাবের সঙ্গে যে-ই না দেখা হলো অমনি কথা উঠল তোমার বান্ধবী রুনাকে নিয়ে!
: কেন? রুনার কথা আবার এল কোথা থেকে?
: শিহাব নাকি রুনার ছোট বোন রাশাকে দেখেছে।
: তাতে কী?
: আরে, শিহাব না তার জন্য পাত্রী খুঁজছে!
পাত্রীর কথা শুনে আমার বউয়ের মুখে এক ধরনের কৌতূহল ফুটে উঠল। যাক, পাত্রী ইস্যুটা বোধ হয় কাজে আসছে! কথা বাড়িয়ে চললাম তাই।
: শিহাব বলল রাশা নাকি দেখতে খুব সুন্দর!
: হবেই তো! কার বান্ধবীর বোন দেখতে হবে না!
: হ্যঁা, সেদিন মার্কেটে নাকি দেখেছে।
: কাকে?
: রাশাকে।
: কিন্তু রাশা তো এক মাস হলো নিউইয়র্কে!
এই যা! ধরা বোধ হয় খেলাম! কী দারুণ যাচ্ছিল ইস্যুটা। এবার? বললাম, ‘আরে, মার্কেটে দেখেছে মানে মার্কেটে তার এক বন্ধুর ফেসবুকে দেখেছে! নিউইয়র্ক থেকে রাশা নাকি ছবি পোস্ট করেছে!’
: ও, তাই বলো। ছবি তো না সব কটা সেলফি! সেলফি যে এমন তুলেছে...
আমার বউ সেলফি নিয়ে লম্বা বক্তৃতা শুরু করে দিলো। বুঝলাম সেলফিও খুব ভালো ইস্যু। এই ইস্যুতে লম্বা সময় কথা হতে পারে। তাতে মরিচ ইস্যুটা একেবারে ঢাকা পড়তে কোনো বাধা থাকে না! ফলে আমি বউকে নানাভাবে সেলফি বিষয়ে উসকাতে থাকলাম। বললাম, ‘না না, সেলফি কি আর সবাই তুলতে পারে! তা ছাড়া সেলফির আগেও ছবি ছিল এই দুনিয়ায়...সেলফির পরেও ছবি থাকবে, তাই না?’
: ঠিক তাই। রাশার এটা বোঝা উচিত—মানুষ এনেছে সেলফি...সেলফি আনেনি মানুষ কোনো!
: বাহ্, কী দারুণ বলেছ! দারুণ!
: কাজী নজরুলের কাছ থেকে কোট করেছি! আমি শুধু সেলফি ঢুকিয়ে দিয়েছি!
: তোমার তুলনা হয় না! ইউ আর গ্রেট!
: কিন্তু শিহাবের ব্যাপারে কী যেন বলছিলে?
: কই? কখন?
তখন মনে এল, আমি আসলে ইস্যু দিয়ে ইস্যু ঢাকার চেষ্টা করছি। এবং মরিচ ইস্যু আসলে ঢাকছিলাম শিহাব ইস্যু দিয়ে। তাড়াতাড়ি বললাম, ‘শিহাব...শিহাব...হ্যঁা হ্যঁা, শিহাব তো তোমার খুব প্রশংসা করছিল!’
: প্রশংসা করছিল?
: হ্যঁা, বলল, আমি নাকি খুব লাকি...তাই তোমার মতো বউ পেয়েছি!
দেখলাম বউয়ের মুখটা একটু রঙিন হয়ে উঠছে। ভাবলাম আসলেই সব ইস্যুর বড় ইস্যু হলো প্রশংসা! মনে মনে ভাবলাম, এ যাত্রায় বেঁচেই গেলাম তাহলে!
: তা কী নিয়ে প্রশংসা করছিল শিহাব?
বুঝলাম, বউ আমার আরও প্রশংসা শুনতে চায়। আবারও বানিয়ে বানিয়ে বলা শুরু করলাম।
: আরে, একটা প্রশংসা করল যে বলতে পারব? তোমার চিন্তাভাবনা-রান্না...
: রান্না?
: হঁ্যা, ওই যে আমার লাঞ্চে তুমি আলুভর্তা করে দিয়েছিলে। শিহাব তো সেটা খেয়েছিল, একেবারে আঙুল চেটেপুটে খেয়েছিল। বলছিল, তেমন ঠিক পরিমাণের ঝাঁজ আর ঝালের আলুভর্তা নাকি সে অনেক দিন খায়নি...!
বউ হাসছিল আমার কথা শুনে। বোঝাই যাচ্ছিল, তার খুবই আনন্দ হচ্ছে মনে মনে। সে আনন্দ লুকিয়ে রাখার চেষ্টাও করছিল না। কিন্তু ‘ঝাল’ শব্দটা শোনামাত্র হঠাৎই তার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল।
: ঝাল...মানে মরিচ...অ্যাই, তুমি মরিচ আনোনি? কেন আনোনি? আমি মরিচ ছাড়া এখন অত সুন্দর আলুভর্তা কী করে বানাব?
আমার বুকটা আরেকবারের মতো ধড়াস করে উঠল। বউ বলল, ‘যাও, এক্ষুনি মরিচ নিয়ে আসো!’
: কিন্তু শোনো, বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে...
: বৃষ্টির ইস্যু দিয়ে তুমি আমার মরিচকে আটকে রাখতে পারবে না! বৃষ্টি হোক আর ঝড় হোক, মরিচ আমার লাগবেই! যাও!
ছাতাটা নিয়ে আমি মরিচ আনার উদ্দেশ্যে বের হলাম। বুঝলাম, হায়! ইস্যু দিয়ে আসলে ইস্যু ঢেকে রাখা যায় না!