ইতিহাসের এই দিনে

ফুটবল জাদুকর ডিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যু

ডিয়েগো ম্যারাডোনা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

সর্বশেষ রাশিয়া বিশ্বকাপেও ছিলেন তিনি। চলমান কাতার বিশ্বকাপে উপস্থিত থাকলে নিজেদের প্রথম ম্যাচে পরাজিত আর্জেন্টিনাকে ঘুরে দাঁড়ানোর উৎসাহ জোগাতে পারতেন। আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের প্রেরণার প্রধান উৎস ডিয়েগো ম্যারাডোনা। কেবল কি আর্জেন্টিনা ফুটবল? বাংলাদেশের মতো বহু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কত শিশু-কিশোর যে স্বপ্ন দেখে ম্যারাডোনা হওয়ার! আজ থেকে ২ বছর আগে সেই ফুটবল জাদুকর চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে।

ম্যারাডোনাকে বিবেচনা করা হয় বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে। ফুটবল মাঠে বল নিয়ন্ত্রণ করে নিজের এবং অন্যদের গোল করার সুযোগ তৈরির অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। আর্জেন্টিনা জাতীয় দল, ইতালি এবং স্পেনের বিভিন্ন ক্লাব দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তাঁর নেতৃত্বে। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ আর ম্যারাডোনা দুটোই সমার্থক হয়ে গেছে। সে বছর তাঁরই নেতৃত্বে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা।

ম্যারাডোনার জন্ম ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর, আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসের ল্যানুস শহরে। ছোটবেলা থেকে ফুটবলে নিজের জাত চেনাতে শুরু করেছিলেন। ছোটদের ফুটবল দল ‘দ্য লিটল অনিয়ন’- এ যোগ দেন মাত্র ৮ বছর বয়সে। এই দল একটানা ১৩৬টি ম্যাচ জিতেছিল। ১৪ বছর বয়সে ফুটবল ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্সের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। ১৬তম জন্মদিনের আগেই ম্যারাডোনা পা রাখেন প্রথম বিভাগ ফুটবলের মাঠে। এর চার মাস পর আর্জেন্টিনার সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে যোগ দেন জাতীয় দলে। বয়স কম থাকায় কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ দলে ম্যারাডোনাকে দলে রাখেননি। পরের বছর জাপানে অনুষ্ঠিত ফিফা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপে তাঁর নেতৃত্বে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয় এবং ম্যারাডোনা হন সেরা খেলোয়াড়।

১৯৮১ সালে বোকা জুনিয়র্সে যোগ দেন ম্যারাডোনা। তাঁর তেলেসমাতিতে চ্যাম্পিয়ন হয় ক্লাবটি। এরপর ইউরোপে গিয়ে খেলেন বার্সেলোনা, নাপোলি ও সেভিলা ক্লাবের হয়ে। অল্প দিনের জন্য আর্জেন্টিনার নেয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাবে খেলার পর ১৯৯৫ সালে ফিরে যান বোকা জুনিয়র্সে।

ম্যারাডোনা ১৯৮২, ১৯৮৬, ১৯৯০ ও ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে খেলেছেন। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে হাঙ্গেরির বিপক্ষে দুটি গোল করা ছাড়া বলার মতো তেমন কিছু নেই। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা আবির্ভূত হন স্বমহিমায়। কোয়ার্টার ফাইনালে বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় দুটি গোল করেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। প্রথম গোলটি করেন হাত দিয়ে, যা ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল নামে পরিচিত। এই বিতর্ক পেছনে ফেলে মাত্র ৪ মিনিট পরে মিডফিল্ড থেকে বলের দখল নিয়ে মাঠের অর্ধেকেরও বেশি অংশ পাড়ি দিয়ে এবং একে একে পাঁচজন ডিফেন্ডার এবং গোলরক্ষককে কাটিয়ে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গোলটি করেন জাদুকর। এরপর সেমিফাইনালে আরও দুটি গোল করে একক কৃতিত্বে ফাইনালে নিয়ে যান আর্জেন্টিনাকে। ফাইনালে গোল না করলেও জয়সূচক গোলের পেছনে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার ওঠে তাঁরই হাতে।

১৯৯০ সালের বিশ্বকাপেও ম্যারাডোনা ঝলক দেখা গেছে। তবে ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে নজরকাড়া সাফল্যের পর ওই বিশ্বকাপে ব্যাপকভাবে ফাউলের শিকার হন তিনি। দ্বিতীয় পর্বে ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যারাডোনার অসাধারণ পাস থেকে ক্যানিজিয়া একমাত্র গোলটি করেন। ফাইনালে জার্মানির কাছে বিতর্কিত পেনাল্টিতে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। ড্রাগ পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে ম্যারাডোনা ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ শেষ করতে পারেননি। গ্রুপ পর্ব থেকেই ছিটকে পড়ে তাঁর দল।

ম্যারাডোনা ২১ বছরের পেশাদার ক্যারিয়ারে ৪৯০টি ম্যাচ খেলেছেন, গোল করেছেন ২৫৯টি। এর মধ্যে আর্জেন্টিনার হয়ে ৯১ ম্যাচে গোল করেন ৩৪টি। শেষ ম্যাচটি খেলেন ১৯৯৭ সালের ২৫ অক্টোবর।

২০০৮ সালে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচের দায়িত্ব পান ম্যারাডোনা। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে ৪ গোলে পরাজিত হওয়ার ফলে তাঁর চুক্তির মেয়াদ আর বাড়ানো হয় না। এরপর বেশ কিছু ক্লাবে কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচন করার সময় ফিফা ইন্টারনেটে একটি জরিপ চালায়। সেখানে ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট পেয়ে ম্যারাডোনা শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। ২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর বুয়েনস এইরেসেরে টাইগ্রে শহরে মারা যান ম্যারাডোনা। তবে ফুটবল জাদুকর ছায়া হয়ে সব সময় আর্জেন্টিনা দলের সঙ্গেই আছেন, আর আছেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে।