ইতিহাসের এই দিনে

পৃথিবীর সবচেয়ে বিধ্বংসী পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ

ভূমি থেকে জার বোমা বিস্ফোরণ দেখতে যেমন ছিল
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে সবাই ভেবেছিল, ইউক্রেন সহজেই পরাজিত হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আট মাস পার হয়ে গেলেও এ যুদ্ধে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ পরাশক্তি রাশিয়া তেমন সুবিধা করতে পারেনি। বরং ইউক্রেনের কঠোর প্রতিরোধের মুখে বিভিন্ন এলাকা থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হচ্ছে তারা। এর মধ্যে আংশিক সেনা সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, দিয়েছেন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকিও। যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হলে এবং যুদ্ধের ফল নিজের অনুকূলে না গেলে পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে বসতে পারেন বলে মনে করেন অনেকে।

পারমাণবিক বোমা কতটা বিধ্বংসী হতে পারে, তা আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেখেছি। তবে এখন তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা পরাশক্তি দেশগুলোর কাছে আছে। এমন একটি বোমা হলো রাশিয়ার ‘জার বম্ব’ বা জার বোম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের দুটি শহর ধ্বংস করা ‘লিটল বয়’ আর ‘ফ্যাটম্যান’–এর চেয়ে জার বোমা হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। প্রকৃতপক্ষে জার বোম হলো এখন পর্যন্ত মানুষের আবিষ্কার করা সবচেয়ে বিধ্বংসী পারমাণবিক বোমা।

১৯৫২ সালে পৃথিবীর প্রথম হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নও হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকে। অল্প দিনের মধ্যেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বোমার চেয়ে বিধ্বংসী একটি বোমা তৈরি করতে সক্ষম হয়, যা জার বোমা নামে অধিক পরিচিত।

তিন স্তরবিশিষ্ট এই হাইড্রোজেন বোমার নকশা করেন আন্দ্রে শাখারভসহ বেশ কজন পরমাণুবিজ্ঞানী। প্রথমে ১০০ মেগাটন টিএনটিসম্পন্ন এবং ফ্যাটম্যানের চেয়ে পাঁচ হাজার গুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন বোমার নকশা করা হয়। তবে এত ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা বহনকারী বিমান বিস্ফোরণের পর ফিরে আসার মতো পর্যাপ্ত সময় না–ও পাওয়া যেতে পারে, এই চিন্তা থেকে বোমার ক্ষমতা অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়। বোমাটি তৈরি করার পর এর ওজন দাঁড়ায় ২৭ মেট্রিক টন, যার দৈর্ঘ্য ৮ মিটার এবং প্রস্থ ২ মিটার। বোমাটি তৈরির পাশাপাশি বোমা বহনের জন্য একটি বিমানকেও উপযোগী করে তোলা হচ্ছিল।

রাশিয়ার সারভ অ্যাটমিক বম্ব মিউজিয়ামে জার বোমার খোলসের প্রতিরূপ

তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো বিমান এই বোমা বহনে সক্ষম ছিল না। বিকল্প হিসেবে টিইউ–৯৫ভি বিমানকে এই বোমা বহনের জন্য উপযোগী করে তোলা হয়। বিমানটিকে বিশেষ প্রতিফলক দ্বারা রং করা হয়, যা বোমার বিস্ফোরণে সৃষ্ট তেজস্ক্রিয়তা প্রতিফলন করতে সক্ষম ছিল। তা ছাড়া বোমাটি নিক্ষেপ করার পর বহনকারী বিমান যাতে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে পারে, সে জন্য (অর্থাৎ বোমাটির পতনকে ধীর করার জন্য) প্যারাসুটের মাধ্যমে নিক্ষেপ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও বহনকারী বিমানটির চালকের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা ছিল ৫০ শতাংশ।

১৯৬১ সালের ৩০ অক্টোবর বোমাটিকে উত্তর মহাসাগরে অবস্থিত নোভেয়া জেমলিয়া দ্বীপের ওপর নিয়ে আসা হয়। একটি পর্যবেক্ষক বিমান এই ঘটনার ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে থাকে এবং একই সঙ্গে বাতাসে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা পরিমাপ করতে থাকে। বোমাটিকে সাড়ে ১০ কিলোমিটার ওপরে প্যারাসুটের মাধ্যমে মুক্ত করা হয় এবং সেটি বিস্ফোরিত হয় ভূমি থেকে ৪ কিলোমিটার ওপরে। ততক্ষণে বহনকারী বিমানটি ৩৯ কিলোমিটার এবং পর্যবেক্ষক বিমানটি ৫৪ কিলোমিটার দূরে চলে আসতে সক্ষম হয়। তা সত্ত্বেও বিস্ফোরণের শক ওয়েভ বহনকারী বিমানটিকে ১১৫ কিলোমিটার এবং পর্যবেক্ষক বিমানটিকে ২০৫ কিলোমিটার দূরে গিয়ে ধাক্কা দেয়। এর ফলে বিস্ফোরণের শক ওয়েভ বহনকারী বিমানটিকে ১ কিলোমিটার দূরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তবে এতে বিমানটির কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয় না।

বোমাটির বিস্ফোরণে ৫৬ মেগাটন টিএনটি নির্গত হয়। বিস্ফোরণে সৃষ্ট মাশরুম আকৃতির মেঘ প্রায় ১০০ কিলোমিটার বিস্তৃত হয়ে ৬৪ কিলোমিটার উচ্চতায় পৌঁছে যায়, অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের স্ট্যাটোস্ফিয়ার পার হয়ে মেসোস্ফিয়ারের মধ্যে চলে যায়। বিস্ফোরণে সৃষ্ট অগ্নিগোলকটির ঝলকানি এক হাজার কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যায়। ধ্বংস হয়ে যায় বিস্ফোরণ স্থলের ৫৫ কিলোমিটার দূরে সেভারি দ্বীপের সব স্থাপনা। দ্বীপটি অবশ্য আগে থেকেই জনশূন্য করা হয়েছিল। ভূপৃষ্ঠের ৪ কিলোমিটার ওপরে বিস্ফোরিত হওয়ার পরও এর শক ওয়েভ ৪ দশমিক ২৫ মাত্রার ভূকম্পন সৃষ্টি করে এবং বেতার যোগাযোগব্যবস্থা হয়ে পড়ে অকেজো।

১৬১ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা গিয়েছিল বিস্ফোরিত জার বোমার ‘মাশরুম’

১৯৬০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একহাত দেখিয়ে নেওয়ার বিষয়ে ‘কুজকিনা ম্যাট’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছিলেন। রাশিয়ার এই জনপ্রিয় উক্তি ইংরেজিতে ‘আমরা দেখাব’ হিসেবে অনূদিত হয়। তবে এর বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় ‘এমন কিছু করব, যা আগে কখনো দেখেননি’। এই বোমার বিস্ফোরণের পর অনুমান করা হয় ক্রুশ্চেভ তাঁর ভাষণে ইঙ্গিতে এই বোমার কথাই বলেছিলেন। এই বিস্ফোরণের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাৎক্ষণিকভাবে সোভিয়েত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ক্রুশ্চেভ সম্ভবত এটাই চাইছিলেন।

জার বোমা ছিল পৃথিবীতে বিস্ফোরিত সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা। এর শক্তি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত সব ধরনের অস্ত্র ও বোমার সম্মিলিত শক্তির ১০ গুণ। পরমাণুবিজ্ঞানীরা জানান, কোনো বড় শহর ধ্বংস করতে হলেও এমন একটি বোমার ব্যবহার অতিরিক্ত হয়ে যাবে। এই বোমা যদি কোনো শহরে নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে এর প্রভাব থেকে আক্রমণকারী রাষ্ট্রও বাঁচবে না। কারণ, এর তেজস্ক্রিয়তা সারা বিশ্বের বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়বে। এই বিস্ফোরণের কিছুদিন পরই আন্দ্রে শাখারভ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন। এর ফলে তিনি সোভিয়েত ভিন্নমতাবলম্বীরূপে চিহ্নিত হন।