চীনকে হংকং ফিরিয়ে দিতে রাজি হয় ব্রিটেন

১৮৬৮ সালে হংকং
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

চীনের দুটি বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের একটি হংকং, অন্যটি ম্যাকাও। ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতি অনুসারে চীনের অধীন থাকা এই অঞ্চল দুটির আছে স্বায়ত্তশাসন ও নিজস্ব সরকারব্যবস্থা। হংকং চীনের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের একটি সমৃদ্ধিশালী দ্বীপ। চীনের ‘প্রবেশদ্বার’ নামে পরিচিত হংকং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এর আয়তন ১ হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার। হংকং একসময় ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। উপনিবেশ হিসেবে ৯৯ বছরের ইজারার মেয়াদ শেষ হলে ১৯৯৭ সালে ব্রিটেন চীনের কাছে হংকংকে ফিরিয়ে দেয়।

আদিম প্রস্তর যুগ থেকে হংকংয়ে জনবসতির নিদর্শন পাওয়া যায়। ২৪৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চীনের কিং সাম্রাজ্যের সময় প্রথমবারের মতো হংকং চীন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে দুই হাজার বছর ধরে হংকং চীনের অধীনেই ছিল। রানি ভিক্টোরিয়ার আমলে হংকং পরিণত হয় ব্রিটিশ উপনিবেশে। হংকংয়ের ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হওয়ার পেছনে আছে ‘আফিম যুদ্ধের’ ভূমিকা।

ব্রিটিশ হংকংয়ের পতাকা (১৯৫৯–১৯৯৭)

উনিশ শতকের শুরুতে ব্রিটেনে চীনা চায়ের কদর বেড়ে গেলে ব্রিটিশ সরকার চীন থেকে চা আমদানি করতে চায়। চীনা বাজারে ব্রিটিশ পণ্যের চাহিদা না থাকায় চীন সরকার সোনা বা রুপার বিনিময়ে চা বিক্রি করতে রাজি হয়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে সংগৃহীত আফিমের পরিবর্তে চা কেনার কৌশল অবলম্বন করে। চীনা সরকারের আপত্তির মুখে ব্রিটিশ বণিকেরা চোরাকারবারির মাধ্যমে চীন থেকে আফিমের বিনিময়ে চা সংগ্রহ করতে শুরু করেন। ১৮৩৯ সালে চীন সরকার ব্রিটেনের ২০ হাজার বস্তা আফিম ধ্বংস করে দেয়। ব্যবসা ব্যাহত হওয়ায় ব্রিটিশ সরকার চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত চলা প্রথম আফিম যুদ্ধে চীন পরাজিত হয়। এই যুদ্ধ চলাকালে ১৮৪১ সালে ব্রিটেন হংকং দ্বীপ দখল করে নেয় এবং হংকংকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। নানকিং চুক্তির মাধ্যমে হংকং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘ক্রাউন কলোনি’তে পরিণত হয়। কিন্তু এরপরও আফিম বাণিজ্য নিয়ে চলমান দ্বন্দ্বের অবসান হয়নি। কয়েক বছরের মধ্যেই তা আবার চরম আকার ধারণ করে, শুরু হয় দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ। ১৮৫৬ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ ১৮৬০ সালে পিকিং কনভেনশন স্বাক্ষরের মাধ্যমে শেষ হয়। দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ শেষে হংকংয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন মজবুত হয় এবং চীন হংকং দ্বীপসংলগ্ন প্রায় ২৫০টি উপদ্বীপ ব্রিটেনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। উপনিবেশ দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে ব্রিটেন হংকংসহ আরও কিছু অঞ্চল ইজারা নিতে চাইলেও ১৮৯৮ সালে সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুসারে চীন সরকার ব্রিটেনকে শুধু হংকং দ্বীপ ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিতে সম্মত হয়।

হংকং দুনিয়ার অন্যতম ব্যস্ত কন্টেইনার বন্দর

ইজারার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই হংকংকে চীনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯৮৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর বেইজিংয়ের ‘হল অব দ্য পিপল’-এ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এবং চীনা প্রধানমন্ত্রী ঝাও জিয়াং হংকংকে চীনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার যৌথ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। ঘোষণাপত্র অনুযায়ী ব্রিটেন হংকংকে ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই চীনের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি হয়। তবে ব্রিটেন হংকংয়ে আরও ৫০ বছর পুঁজিবাদ টিকিয়ে রাখতে চায়। ফলে ঘোষণাপত্রের অন্যতম শর্ত ছিল চীনের অধীনে যাওয়ার ৫০ বছর পর্যন্ত চীন হংকংকে ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতি অনুযায়ী শাসন করবে অর্থাৎ পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো ছাড়া হংকং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই মধ্যরাতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, প্রিন্স চার্লস, চীনের প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাডেলিন অলব্রাইটসহ অনেক আন্তর্জাতিক নেতার অংশগ্রহণে হংকংকে শান্তিপূর্ণভাবে চীনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

হস্তান্তরের পর থেকে চীন হংকংয়ের ওপর কর্তৃত্ববাদী আচরণ শুরু করে। ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন ও অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় রাখার অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও চীন সরকার হংকংবাসীর পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দিতে গড়িমসি করে। হংকংয়ের জনগণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁদের নেতা নির্বাচন করতে চান, কিন্তু চীন সরকার চায় তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে হংকং শাসনের জন্য নিযুক্ত করতে। ফলে চীন সরকার তাদের পছন্দের তালিকা থেকে হংকংয়ের নেতা নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। চীন সরকার হংকংয়ের নাগরিকদের বিচারের জন্য চীনে প্রত্যর্পণের অনুমতি দিয়ে একট আইন পাস করলে ২০১৯ সালের জুন মাসে হংকংয়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। চীন সরকারের বিরুদ্ধে হংকংয়ের ১০ লাখের বেশি মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে আইনটি বাতিল করলেও চীন সরকার ২০২০ সালে ‘জাতীয় নিরাপত্তা আইন’ নামে নতুন একটি আইন প্রতিষ্ঠা করে। এ আইন অনুযায়ী, গণমাধ্যম বন্ধ করাসহ নাগরিকদের কণ্ঠরোধ করে রাখা হয়।

হংকংয়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয় ২০১৯ সালে

চীন বরাবরই হংকংকে তাদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে এসেছে। চীন সরকার মনে করে, হংকং কখনো ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল না; বরং ব্রিটিশরা কেবল ঔপনিবেশিক শাসন চালিয়েছে। হংকং ইজারা দেওয়ার চুক্তি সম্পর্কে চীন সরকারের ভাষ্য ‘চাপের মুখে’ চুক্তিটি করা হয়েছিল। তা ছাড়া চীন মনে করে, ১৯৯৭ সালে ব্রিটেন হংকংকে চীনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে চুক্তির অবসান ঘটেছে। ধারণা করা হয়, ২০৪৭ সালে ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নীতির বাধ্যবাধকতা উঠে গেলে চীন হংকংকে নিজেদের একটি প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করবে। ফলে এই শতকের মাঝামাঝি সময়ে তাইওয়ানের মতো হংকংও হয়ে উঠতে পারে বিশ্বরাজনীতির একটি বিরোধপূর্ণ অঞ্চল।